ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি আলোচনা কর।

by - July 06, 2022

ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি আলোচনা কর। 

ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রশাসনিক সংস্কারগুলি আলোচনা কর। 

সুলতানি সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণে ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন ? 

ফিরোজ শাহ তুঘলককে '' সুলতানি যুগের আকবর '' বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ? 

ফিরোজ শাহ তুঘলককে '' আকবরের পূর্বসূরি '' বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ?   




ফিরোজ শাহ তুঘলক ( ১৩৫১ - ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ ) :- 


১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে ৪৬ বছর বয়সে ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনলাভ করেন। এরপর তিনি নিজ সিংহাসন সুরক্ষিত করতে ও সুলতানির দৃঢ়করণে বহু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক গৃহীত শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি নীচে আলোচনা করা হল। 


(A) ধর্মাশ্রয়ী রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা :- যেহেতু ফিরোজের মাতা ছিলেন হিন্দু রমণী এবং ফিরোজ নিজেও যুদ্ধকৌশলী ব্যক্তি ছিলেন না ,তাই সিংহাসন আরোহন করেই তিনি ধর্মাশ্রয়ী রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শাসনতান্ত্রিক কার্যে উলেমা ও শরিয়তকে গুরুত্ব প্রদান করেন ; খলিফার স্বীকৃতিলাভ করেন এবং নিজেকে '' খলিফার ভৃত্য '' বলে ঘোষণা করেন। 

(B) অভিজাত ও উলেমা সংক্রান্ত নীতি :- ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে বসেই অভিজাত ও উলেমাদের প্রতি পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতিকে পরিত্যাগ করেন। যেহেতু ফিরোজ অভিজাতদের সমর্থন নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন , সেহেতু তিনি অভিজাতদের সন্তুষ্টিবিধানে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। তিনি জায়গির প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেন , অভিজাতদের মধ্যে প্রচুর ধন - সম্পত্তি বন্টন করেন , উলেমা ও অভিজাতদের উপর থেকে গুপ্তচরদের নজরদারি সরিয়ে নেন। 

(C) অর্থনৈতিক সংস্কার :- ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন সিংহাসনারোহন করেন তখন দিল্লি সুলতানির অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা ভেঙে পড়েছিল। তাই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(i) তাঁর পূর্বসূরি কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত ঋণভার থেকে জনগণকে মুক্ত করেন। 
(ii) দুর্ভিক্ষ , মহামারী - ইত্যাদির সময়ে সমস্ত রকম খাজনা মুকুব করেন। 
(iii) তিনি চব্বিশ রকমের অবৈধ খাজনা বাতিল করেন। 
(iv) পূর্ববর্তী ভ্রান্ত পরিকল্পনাগুলির জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন। 
(v) শুধুমাত্র নির্ধারিত কর ছাড়া প্রজাদের কাছ থেকে যেন অতিরিক্ত কর আদায় না করা হয় - সে ব্যাপারে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল।
(vi) অন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক প্রত্যাহার করে তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র অবাধ বাণিজ্যের চলাচল সম্ভব করেন। 


(D) রাজস্ব সংস্কার :- ফিরোজ শাহ তুঘলক কোরানে উল্লিখিত চার ধরণের রাজস্ব ধার্য করেন। এই চার ধরণের রাজস্ব ছাড়া অন্য সকল প্রকার কর নিষিদ্ধ করা হয়। এই চার ধরণের রাজস্ব ছিল - 
(i) খারাজ বা ভূমিকর। 
(ii) খামসা বা লুন্ঠিত দ্রব্যের এবং খণিজ দ্রব্যের এক - পঞ্চমাংশ কর। 
(iii) জিজিয়া বা অ - মুসলমানদের উপর ধার্য কর। 
(iv) জাকাত বা দান। জাকাত শুধুমাত্র মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হত এবং তা ধর্মীয় কার্যে ব্যয় করা হত।  


(E) কৃষির উন্নতির জন্য গৃহীত পদক্ষেপ :- সেচব্যবস্থা ও কৃষির উন্নতির জন্য ফিরোজ শাহ তুঘলক একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(i) কৃষি ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য ফিরোজ খাল খনন করে জলসেচ সহজ করে তোলেন। তিনি মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সেচখাল খনন করেন - যেমন - যমুনা থেকে হিসার , শতদ্রু থেকে ঘর্ঘরা , ঘর্ঘরা থেকে ফিরোজাবাদ - ইত্যাদি। 
(ii) সেচখাল ছাড়াও তিনি একশত পঞ্চাশটি কূপ খনন করেন। 
(iii) বহু পুস্করিণী খনন করেন। 

(F) জায়গির ও মুদ্রা সংস্কার :- সরকারি কর্মচারী ও সেনাদের বেতনের পরিবর্তে জায়গীর প্রদানের নীতি গৃহীত হয়। এই সময় জায়গীরদারি প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। মুদ্রা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ফিরোজ শাহ তুঘলক সম্পূর্ণ নতুন মুদ্রানীতি গ্রহণ করেন। জিতল , আধা - জিতল , সিকি - জিতল - ইত্যাদি স্বল্পমূল্যের মুদ্রা চালু করলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সহজ হয়। খাঁটি সোনা ও রৌপ্যের মুদ্রা প্রচলন করে তিনি মুদ্রাব্যবস্থাকে নির্ভরযোগ্য করে তোলেন। 

(G) প্রশাসনিক ও সামরিক সংস্কার :- এক শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলক প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বহুবিধ সংস্কার সাধন করেন। যেমন - 
(i) সৈনিক ও কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জায়গির প্রদান করা হয়। 
(ii) আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক স্থাপিত স্থায়ী সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় এবং প্রাদেশিক সেনাদলের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। 
(iii) আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক প্রবর্তিত ' দাঘ ' ও ' হুলিয়া ' ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। 
(iv) সেনাবাহিনীতে বংশানুক্রমিক নীতি প্রবর্তিত হয়। 
(v) আলাউদ্দিন খলজি প্রতি বছর প্রতিটি সৈনিক ও তার অশ্বের পরীক্ষা করতেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। 
বলা বাহুল্য উপরোক্ত পদক্ষেপগুলির জন্য সুলতানি সামরিক বাহিনী দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে।   


(H) জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী :- ফিরোজ শাহ তুঘলক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাঁর জনহিতকর কার্যাবলির জন্য। প্রজাগণের কল্যাণের জন্য তিনি বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(i) কৃষির উন্নতির জন্য তিনি বহু সেচখাল , পুস্করিণী ও কূপ খনন করেন। 
(ii) কর্মসংস্থান সংস্থা স্থাপনের মাধ্যমে তিনি বেকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। 
(iii) দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধের জন্য তিনি বহু দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। 
(iv) অনাথ , দুঃস্থ বিধবা , সুফি - সন্ত - দরবেশ - ফকির - প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে সাহায্য করার জন্য দেওয়ান - ই - খয়রাত - নামক পৃথক একটি দপ্তর গঠন করেন। 
(v) যোগ্য ও উদ্যোমী ব্যক্তিদের অর্থসাহায্য করার জন্য দেওয়ান - ই - ইস্তিহক নামক অপর এক দপ্তর গঠন করেন। 
(vi) কৃষির উন্নতির জন্য প্রায় ৫০ টি বাঁধ , ৩০ টি জলাধার নির্মাণ করেন। 
(vii) শিক্ষার প্রসারের জন্য বহু মক্তব ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি প্রায় ৩০ টি কলেজ নির্মাণ করেছিলেন। 
(viii) জ্ঞানীগুণীদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি রাজকোষ থেকে অর্থব্যয় করেন। 
(ix) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি প্রায় ১৫০ টি সেতু নির্মাণ করেন। 
(x) তিনি বহু শহরের পত্তন করেন। প্রায় ২০০ টি শহর তিনি নির্মাণ কোরেছিলেন। যেমন - ফিরোজপুর , ফিরোজাবাদ , হিসার - ইত্যাদি। 
(xi) তিনি পূর্ববর্তী সুলতানদের নির্মাণকীর্তিগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করেন। 
(xii) তিনি অসংখ্য বাগান ও কারখানা নির্মাণ করেন।     

সুলতানি যুগের আকবর / আকবরের পূর্বসূরি :- 

হেনরি এলিয়ট ও এলফিনস্টোন ফিরোজ শাহ তুঘলককে '' সুলতানি যুগের আকবর '' বলে অভিহিত করেছেন। মূলতঃ তাঁর জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এই কার্যাবলিগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁর মহৎ প্রাণের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে কৃষির উন্নতি সাধিত হয় , পানীয় জলের সমস্যা দূর হয় , শিক্ষার প্রসার ঘটে , জ্ঞানীজন পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন , বহু নগরের পত্তন ঘটে। মানবধর্মিতার দিক দিয়ে দেখলে তিনি ছিলেন দিল্লি সুলতানির শ্রেষ্ঠ সুলতান। 

কিন্তু ডক্টর ঈশ্বরীপ্রসাদ ও ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার ফিরোজ শাহ তুঘলককে আকবরের পূর্বসূরি বলতে রাজি নন। তাঁদের মতে , প্রথমতঃ - ফিরোজ শাহ কখনই আকবরের মত প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করেন নি ; দ্বিতীয়তঃ আকবর হিন্দুদের প্রতি উদার মনোভাব গ্রহণ করে তাঁদের সমর্থন লাভ করেছিলেন ও মোগল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্টিত করেছিলেন , অন্যদিকে ফিরোজ হিন্দুদের বিরুদ্ধাচারণ না করলেও তাঁদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন এবং তাঁদের সমর্থনলাভের চেষ্টা করেননি ; তৃতীয়তঃ আকবর নিজ সাংগঠনিক প্রতিভার জোরে এক দক্ষ কেন্দ্রীভূত শাসন গড়ে তুলেছিলেন , কিন্তু ফিরোজের শাসন কাঠামো দুর্বল ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল ; চতুর্থতঃ আকবর এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন , কিন্তু ফিরোজের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত ছিল দিল্লি কেন্দ্রিক। 

তবে , এসব স্বত্তেও বলা যায় , দিল্লি সুলতানির ৩০০ বছরের ইতিহাসে ফিরোজ শাহ তুঘলক নিজের সংস্কার ও জনদরদী পদক্ষেপগুলির জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আকবরের সমকক্ষ না হলেও তাঁর সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলি যে প্রজাকল্যাণমূলক ছিল - সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।      

 

You May Also Like

0 comments