গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।

by - August 02, 2022

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর। 

গুপ্ত রাজবংশের পতনের জন্য দায়ী কারণগুলি বিশ্লেষণ কর। 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। 



গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। 


গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মূলতঃ দুটি উপাদান দায়ী - অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যর্থতা ও বহিরাক্রমণ। আরব ঐতিহাসিক ইবন খালদুন বলেছেন - '' প্রতিটি সাম্রাজ্যের জন্ম আছে , উত্থান আছে ও পতনও আছে। '' প্রথম চন্দ্রগুপ্ত , সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁচেছিল ; কিন্তু স্কন্ধগুপ্তের পরবর্তী সময়কালে খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী বিভিন্ন উপাদনগুলি ছিল - 


১. আর্থিক বিপর্যয় :- স্কন্ধগুপ্তের পরবর্তী সময়কালে গুপ্ত রাজাদের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় লিপি ও মুদ্রায়। স্বর্ণমুদ্রা বহুগুণে হ্রাস পায়। রৌপ্যমুদ্রাও সীমিত আকারে প্রচলিত ছিল। মূলতঃ পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের আমলে বাণিজ্যিক অবক্ষয়ের কারণেই রৌপ্যমুদ্রা তীব্রভাবে হ্রাস পায় ও স্বর্ণমুদ্রা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। সেই আমলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তীব্র অবনতি ঘটেছিল। গুপ্ত রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে বাণিজ্যের মাধ্যমে পণ্যকে নগদে পরিণত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এইভাবে অর্থের অভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা , প্রশাসনিক অবনতি ও সামরিক বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে। 

২. অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব :- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত রাজবংশে সিংহাসন সংক্রান্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর পুরগুপ্ত , স্কন্ধগুপ্ত ও ঘটোৎকচগুপ্তের মধ্যে বিরোধ শুরু হয় ; স্কন্ধগুপ্তের মৃত্যুর পর পুরগুপ্ত ও দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়  ; এছাড়াও পুরগুপ্তের মৃত্যুর পরও এধরণের অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সিংহাসন অধিকার নিয়ে গুপ্ত রাজবংশের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই বর্তমান ছিল। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ নৃপতিগণ আপন প্রতিভাবলে সেই দ্বন্দ্বের প্রভাব প্রশাসনে পড়তে দেন নি। কিন্তু পরবর্তীকালের গুপ্ত সম্রাটগণ  এই ধরণের কৃতিত্ব প্রদর্শনে ব্যর্থ হন। 

৩. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা :- প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মধ্যে মন্দাশোরের শাসক যশোধর্মন গুপ্ত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মৈত্রক শাসক ভটরক সৌরাষ্ট্র দখল করে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেন। এরপর একে একে কনৌজের মৌখরী বংশ , বলভীতে মৈত্রক বংশ , থানেশ্বরের বর্ধন বংশ - ইত্যাদি প্রাদেশিক শাসনকর্তারা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। 

৪. গুপ্তরাজাদের বৌদ্ধধর্মে অনুরাগ :- প্রথমদিকে গুপ্ত রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী হলেও বুধগুপ্তের আমল থেকে গুপ্ত শাসকেরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি এই আকর্ষণ গুপ্ত রাজাদের সামরিক উৎকর্ষতা বিশেষভাবে খর্ব করে। সামরিক শক্তি এতটাই হীনবল হয়ে পড়েছিল যে , হুণ নেতা মিহিরকুল গুপ্তরাজ বালাদিত্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে বালাদিত্য পলাতক হন এবং জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর মিহিরকুল পরাজিত হয়ে বন্দি হলেও বালাদিত্য তাকে মুক্ত করেন। ধর্মীয় উদারতার দিক দিয়ে এমন আচরণ প্রশংসা পেলেও রাজার কর্তব্য হিসাবে তা কাম্য নয় এবং তা রাজতন্ত্রের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। 


৫. স্থায়ী সেনাবাহিনীর অভাব :- পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। এই সময়কালে গুপ্ত রাজারা সামরিক বিষয়ে প্রাদেশিক শাসক ও সামন্তদের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। ফলে সম্রাটদের তুলনায় প্রাদেশিক শাসক ও সামন্তরাই সামরিক বিভাগের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন। ফলে সামরিক বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রাদেশিক শাসক ও সামন্তগণ নিজেদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে। 

৬. সামন্তপ্রথার প্রভাব :- গুপ্তরাজাদের আমলেই ভারতে সামন্ত প্রথা প্রচলিত হয় ও উন্নতির শিখরে ওঠে। কিন্তু প্রথমদিকে গুপ্তসম্রাটরা শক্তিশালী কেদ্রীকরণের নীতির মাধ্যমে সামন্তরাজাদের রাজতন্ত্রের পক্ষে কাজে লাগাতে পারলেও পরবর্তী গুপ্তরাজদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের আমলে সামন্তরাজারা নিজ নিজ এলাকায় প্রায় স্বাধীন হয়ে উঠেছিলেন। যশোবর্মন , সুবন্ধু প্রাদেশিক শাসনকর্তারা গুপ্ত বংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন - এঁরা সকলেই ছিলেন গুপ্ত রাজত্বের শক্তিশালী সামন্তরাজা। 

৭. প্রশাসনিক ব্যর্থতা :- গুপ্তযুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহুলাংশে আমলা নির্ভর ছিল। এই আমলাতন্ত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল বংশানুক্রমিক। এই বংশানুক্রমিক আমলাতান্ত্রিক শাসনে গুপ্তযুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজকর্মচারীরা দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন ও সরকারি কাজকর্ম ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের আমলে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিলনা বললেই চলে। 

৮. বংশানুক্রমিক নীতি :- গুপ্ত আমলে বহুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীদের পদ ছিল বংশানুক্রমিক। সচিব , অমাত্য , মন্ত্রী এমনকী সামন্তদের পদও ছিল বংশানুক্রমিক। এইভাবে উচ্চপদগুলিতে বংশানুক্রমিক নীতি প্রচলিত হলে কর্মচারীদের দক্ষতা হ্রাস পায় এবং শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। 

৯. ভূমিদান প্রথার কুফল :- গুপ্তযুগে ভূমিদান প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। কিন্তু এই ভূমিদান প্রথা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। দান করা জমিতে রাজার কোনো অধিকার থাকত না। এরফলে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় জমির পরিমাণ ও সেখান থেকে রাষ্ট্রীয় আয় হ্রাস পায় ও অন্যদিকে দান করা জমির উপর রাজা কর্তৃত্ব হারান। পরবর্তীকালে গুপ্ত রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই সকল জমির প্রাপকরা রাজ কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করেন। 

১০. রাজতন্ত্রের বিলাসিতা ও ব্যয়বহুলতা :- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকেই গুপ্ত রাজাদের ও রাজসভার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। যেমন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রের তুলনায় সাহিত্য ও শিল্পচর্চায় অধিক ব্যয় করা হত। কিন্তু পরবর্তী গুপ্তরাজাদের আমলেও এই বিলাসব্যাসন ও ব্যয়বহুলতা বজায় থাকলে তা সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 

১১. দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকার :- গুপ্ত বংশের শেষ শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন স্কন্ধগুপ্ত। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকেরা ছিলেন দুর্বল ও অযোগ্য। স্কন্ধগুপ্তের পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটগণের দুর্বলতার ফলে প্রাদেশিক শাসন ভেঙে পড়ে , কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে , আর্থিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা যায় , সামরিক শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। প্রশাসনিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , কূটনৈতিক - সকল ক্ষেত্রেই তাঁরা দুর্বলতার পরিচয় দেন। 

১২. পুষ্যমিত্র , বাকাটক ও হূণ আক্রমণ :-  প্রথম কুমারগুপ্তের আমলে পুষ্যমিত্রদের আক্রমণ শুরু হলে তা গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষতিসাধন করে। স্কন্ধগুপ্ত বীরত্বের সঙ্গে হুণ আক্রমণ প্রতিহত করলেও তা গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে দেয়। এরপর বুধগুপ্তের আমলে বাকাটকরা ক্রমাগত আক্রমণ শুরু করলে তা গুপ্ত রাজবংশকে আর্থিক - সামরিক সকল দিক দিয়েই দুর্বল করে দেয়। 

ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন - এই বৈদেশিক শক্তির আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য হীনবল হয়ে পড়ে , অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। এই অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তবর্গ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন ও গুপ্ত বংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হন - যা গুপ্ত বংশের পতনকে সুনিশ্চিত করে। 

                    

You May Also Like

0 comments