দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব


বাতাপির চালুক্য কারা ছিলেন ? দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব আলোচনা করো।
অথবা , চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক কে ছিলেন ? তাঁর কৃতিত্ব আলোচনা করো। 

প্রথমে ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দী এবং পরে দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চালুক্যরা দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ইতিহাসে চালুক্যদের চারটি শাখার উল্লেখ পাওয়া যায় -           
১.  বাতাপির চালুক্য
২. বেঙ্গির চালুক্য
৩. কল্যাণের চালুক্য
৪. গুজরাটের চালুক্য।



চালুক্যদের উৎপত্তি সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ তাদের দাক্ষিণাত্যের প্রাচীন কানাড়ী বংশোদ্ভূত বলে মনে করেন। স্মিথের মতে , তারা গুর্জর বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং কোন এক সময় রাজপুতানা থেকে দাক্ষিণাত্যে এসেছিলেন। বাতাপির চালুক্যরা নিজেদের '' হরিতিপুত্র ''  বলে দাবি করেছেন।  তারা নিজেদের ''মানব গোত্র '' ভুক্ত বলেও দাবি করতেন।  ঐতিহ্য ও জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে বলা চলে যে প্রথম চালুক্য রাজা বিজয়াদিত্যের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ অন্ধদেশে রাজত্ব করতেন এবং কৃষ্ণা নদীর তীরে অবস্থিত হিরণ্যরাষ্ট্র নামক জেলাটি বিজয়াদিত্যের বাসভূমি ছিল।  বিজয়াদিত্যের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ ভারতে এসে হিরণ্যরাষ্ট্র নামক অঞ্চল দখল করেন। তারা প্রথমে অন্ধ্রদের শাসনাধীনে ছিলেন এবং অন্ধ্রদের পতনের পর তারা ইক্ষ্বাকুদের শাসনাধীন হন এবং '' মহা সেনাপতি '' , ''মহাতলোয়ার'' প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন।
সুতরাং চালুক্যদের দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় অধিবাসী বলা যায় এবং তাদের আদি বাসভূমি ছিল অন্ধ্রদেশ। বিজয়াদিত্যের বংশধররা বিষ্ণুবর্ধন , জয়সিংহ ও রণরাগ প্রমূখ অন্ধদেশের পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়ে বাতাপিকে কেন্দ্র করে একটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

দ্বিতীয় পুলকেশী ও তার কৃতিত্ব:-( 610 - 642 খ্রিস্টাব্দ ) :-

535 খ্রিস্টাব্দে প্রথম পুলকেশী বাতাপিপুরায় চালুক্য রাজশক্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর চালুক্য সিংহাসনে বসেন তার পুত্র প্রথম কীর্তিবর্মন। কৃতিবর্মনের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা মঙ্গলেশ  597 খ্রিস্টাব্দে চালুক্য সিংহাসনে বসেন।  কিন্তু নিজের পুত্রকে সিংহাসনে বসার চেষ্টা করলে চালুক্য রাজবংশে  দেখা যায় উত্তরাধিকার যুদ্ধ। কীর্তিবর্মনের পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী গৃহযুদ্ধে তাকে নিহত করে 610 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন চালুক্য বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। তিনি ''বল্লভ '' , ''পৃথিবী বল্লভ'' ,  '' পরমেশ্বর পরম ভাগবত ''  প্রভৃতি নামেও পরিচিত ছিলেন।  তার রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দমনে কেটেছিল। মঙ্গলেশ ও পুলোকেশীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে চালুক্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ অবদমিত করার পর তিনি রাজ্য বিস্তারের মনোযোগী হন।
 দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো তার সভাকবি রবিকীর্তি রচিত ''আইহোল- লিপি'' ।



দ্বিতীয় পুলকেশীর  রাজ্য জয় :- 
আইহোল প্রশস্তি অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় পুলকেশী প্রথমেই প্রতিবেশী রাজ্য জয়ের দিকে দৃষ্টি দেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্য বিস্তারের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় '' আইহোল প্রশস্তি '' তে। দক্ষিণে তিনি কাদম্ব ও মহীশুরের গঙ্গবংশীয় নৃপতিদের পরাজিত করেন। উত্তরে কোঙ্কণের মৌর্যদের পরাভূত করে তিনি তাদের রাজধানী পুরী দখল করেন। আরো উত্তরে অগ্রসর হয়ে তিনি মালব ও গুজরাটের রাজন্যবর্গকে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণে বাধ্য করেন।  তিনি পল্লব রাজ প্রথম মহেন্দ্র বর্মন কে পরাজিত করেছিলেন। তিনি কাবেরী নদী অতিক্রম করলে চোল , কেরল ও পান্ড্যরাজ্যের  নৃপতিদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। এইভাবে দ্বিতীয় পুলকেশী দক্ষিণ ভারতের এক বিরাট অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে নিজ  শাসনাধীনে আনতে সমর্থ হন। 

হর্ষবর্ধনের সাথে দ্বন্দ্ব :- 

দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সংঘর্ষে। ডক্টর আর সি মজুমদার উল্লেখ করেছেন পুলকেশীর গুজরাট দখল ভারতীয় রাজনীতির একটি বিশেষ ঘটনা।  কারণ এরপরেই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। গুজরাট ও মালবে হর্ষবর্ধন আক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই অঞ্চলের শাসকগণ দ্বিতীয় পুলকেশীর অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অসন্তুষ্ট পুলকেশী হর্ষবর্ধনের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। স্মিথের মতে ,  নর্মদা নদীর তীরে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয় এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হর্ষবর্ধনের পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।  দ্বিতীয় পুলকেশীর সাথে হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল হর্ষবর্ধন মাত্র একবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় জানা যায় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ দীর্ঘদিন চলেছিল।



পল্লবদের নিকট পরাজিত ও নিহত :-

দ্বিতীয় পুলকেশীর প্রভাব-প্রতিপত্তি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি।  তিনি পল্লবদের পরাজিত করেছিলেন বটে কিন্তু তাদের শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেননি। পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণার্থে পল্লবরা  পুলকেশীর রাজধানী বাদামি  আক্রমণ করে তা দখল করে। পুলকেশী ক্রমাগত পরাজয় স্বীকার করে অবশেষে নিহত হন। দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাতাপির চালুক্য বংশের পতন শুরু হয়।
পল্লবদের সাথে যুদ্ধের গুরুত্ব :-
দ্বিতীয় পুলকেশী মাত্র 32 বছর রাজত্ব করেছিলেন। তার এই 32 বছরের রাজনৈতিক জীবনে পল্লবদের সাথে যুদ্ধ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আইহোল লিপি অনুসারে ডক্টর মহালিঙ্গম উল্লেখ করেছেন - প্রথম অবস্থায় প্রথম নরসিংহ বর্মন পরাজিত হন কিন্তু পল্লব সেনা এরপর রাজধানী বাতাপি আক্রমণ করে দখল করে নিলে দ্বিতীয় পুলকেশী নিহত হন।
পল্লবদের সাথে সংঘর্ষ দ্বিতীয় পুলকেশীর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কেননা এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই-
প্রথমত - চালুক্য বংশের পতনের সূত্রপাত ঘটে।
দ্বিতীয়তঃ - পুলকেশী নিজে নিহত হন
তৃতীয়তঃ - দাক্ষিণাত্যের পল্লব গণের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে থাকে।

তবে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে , রাজনৈতিক অখন্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পুলকেশীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যেমন :-

প্রথমত -  ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত চালুক্য বংশ দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সার্বভৌম শক্তির অক্ষুন্ন রেখেছিল - যার মধ্যে অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী।

দ্বিতীয়ত - চালুক্য রাজাদের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আরবরা দক্ষিণ ভারতের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। আরবদের বিরুদ্ধে দেশরক্ষার দায়িত্ব চালুক্যদেরই বেশি বহন করতে হয়েছিল।  এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পুলকেশীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

তৃতীয়তঃ চালুক্য রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হলেও অপর ধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। দক্ষিণ ভারতের জৈনধর্ম জনপ্রিয় ছিল এবং চালুক্য রাজরা  এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জৈন গ্রন্থকার রবিকীর্তি দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয় চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী শিক্ষা -সাহিত্য -সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন।

চতুর্থত :- চালুক্য রাজাদের আমলে ভারতের ভাস্কর্য ,স্থাপত্য ও চিত্র শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছিল। অজন্তার বহু গুহাচিত্র চালুক্য রাজত্বকালে অঙ্কিত হয়। দ্বিতীয় পুলকেশী নিজেও ছিলেন একজন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পরম পৃষ্ঠপোষক।

পরিশেষে বলা যায় সাম্রাজ্যবাদী শাসক দ্বিতীয় পুলকেশী খুব অল্প সময়কাল রাজত্ব করলেও ভারতের ইতিহাসে তিনি এক উল্লেখযোগ্য অবস্থান ও কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন। কেননা একদিক দিয়ে তিনি যেমন দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যঃ স্থাপন করতে পেরেছিলেন ; তেমনি অন্য দিক দিয়েও নিজের জীবন দশায় চালুক্য বংশ কে দক্ষিণ ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজবংশে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাছাড়া তার আমলে রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে শিক্ষা,সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতির অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল। এই সব দিক বিচার করে তাকে ''দক্ষিণাপথনাথ'' অভিধায় দূষিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকরা কেউ কেউ একমত।

Share
Tweet
Pin
Share