হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব আলোচনা করো। তাকে কি উত্তর পথনাথ বলা যায় ?

হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব আলোচনা করো। তাকে কি উত্তর পথনাথ বলা যায় ? ঐতিহাসিক মূল্যায়ন সহ আলোচনা কর। 

606 খ্রিস্টাব্দে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধন - এর মৃত্যুর পর রাজ্যের অমাত্যদের অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহন করেন।  606 খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি সম্বৎ প্রচলিত করেন যা হর্ষ - সম্বৎ নামে পরিচিত। চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায় যে , রাজ্যশ্রী কারামুক্ত হলে হর্ষবর্ধনের সহযোগিতায় নিজের রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। হর্ষবর্ধন ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা সম্পন্ন পুরুষ এবং প্রজাহিতৈষী রাজা। তিনি রণকুশলী সমরনায়ক ছিলেন সত্য ; কিন্তু সকল সময় তিনি সামরিক প্রতিভা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি।



প্রথমত - দক্ষিণ ভারত ছেড়ে দিলেও তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপন করতে পারেননি।

দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি নিজ সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বটে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কোন প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করেননি।

তৃতীয়তঃ  তিনি শাসনকার্যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন এমন কথা বলা যায় না। কারণ তার সম্রাজ্য নিরুপদ্রব ও শান্তিপূর্ণ ছিল না। দেশে দস্যু - তস্করদের উপদ্রবের ফলে জনসাধারণের ধন ও প্রাণের নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব ছিল।

চতুর্থতঃ তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন তার শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রমাণ করে।
অনেকে হর্ষবর্ধন কে প্রাচীন যুগের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।  কিন্তু এরূপ অনুমান সত্য নয় ; কারণ তার মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচশত বছরের মধ্যে উত্তর ভারতে একাধিক সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল এবং শক্তি ও গৌরবের দিক দিয়ে এই সাম্রাজ্য গুলি হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের তুলনায় কোন অংশেই কম ছিলনা। উদাহরণস্বরূপ প্রতিহার সাম্রাজ্যের উল্লেখ করা যায়।  এছাড়া হর্ষবর্ধন দীর্ঘকাল রাজত্ব করলেও সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার জন্য কোন সক্রিয় গঠন মুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।



যদিও হর্ষবর্ধন কে প্রাচীন যুগের শেষ রাজ্য স্রষ্টা ও দিগ্বিজয়ী বীর বলা যায় না ; তথাপি বহু দিক দিয়ে তার রাজত্বকাল ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। যেমন :- 

⬛গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে প্রথম এক  শতাব্দীকাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় হর্ষবর্ধন সেই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে উত্তর ভারতের বহুলাংশে পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন। তাঁর পরম শত্রূ ও বিজেতা চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী তাকে ''সকলোত্তরা  পথনাথ ''  নামে অভিহিত করেছেন।  হিউ এন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে হর্ষবর্ধন কর্তৃক আহূত কনৌজ   ধর্ম - সম্মেলনে কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মন বলভী রাজ দ্বিতীয় সেন ধ্রূবসেন সহ প্রায় কুড়িজন অনুগত নৃপতিরা উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং উত্তর ভারতের ওপর তিনি যে আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

⬛চিনের সাথে সম্পর্ক ক্ষেত্রেও হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। কণিষ্কের সময় ভারত ও চীনের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তা হর্ষবর্ধনের আমলেও অক্ষুন্ন ছিল।  হর্ষবর্ধনের সঙ্গে চিন সম্রাটের দুবার দুত  বিনিময় হয়। এছাড়া , তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথ এর  গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে , হর্ষবর্ধনের সঙ্গে পারস্য সম্রাটের রাষ্ট্রদূত আদান-প্রদান হয়েছিল।

⬛শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল স্মরণীয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এই যুগের উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান ছিল।  হর্ষবর্ধন ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্য সেবীদের পরম পৃষ্ঠপোষক। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রসার  তার রাজত্বকালের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিউ এন সাং এর বিবরণী থেকে জানা যায় যে , হর্ষবর্ধন রাজস্বের এক - চতুর্থাংশ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করতেন। হর্ষবর্ধন শুধুমাত্র যে একজন বিদ্যোৎসাহী ছিলেন তাই নয় , তিনি নিজেও একজন খ্যাতনামা নাট্যকার ও কবি ছিলেন। তার রচিত '' নাগদত্তা '' , ''রত্নাবলী'' ও '' প্রিয়দর্শিকা '' সুধী সমাজে আদৃত হয়েছিল।


   
⬛সম্রাট অশোকের পর হর্ষবর্ধনের মত প্রজাহিতৈষী রাজা প্রাচীন ভারতে আবির্ভূত হননি।  ইউ এন সাং এর বিবরণ অনুসারে হর্ষবর্ধন দিবারাত্র প্রজাদের মঙ্গলের প্রতি সজাগ থাকেন। তার দানশীলতা চৈনিক পরিব্রাজকে  মুগ্ধ করেছিল।  কথিত আছে , প্রয়াগের ধর্ম সম্মেলনে হর্ষবর্ধন মুক্তহস্তে দান করে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। দানশীলতার এইরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।  তিনি প্রজাদের সুবিধার জন্য সরাইখানা , বিশ্রামাগার , দাতব্য চিকিৎসালয় - প্রভৃতি নানান জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেন। হর্ষবর্ধন ছিলেন অশেষ গুণাবলীর অধিকারী। পিতৃভক্তি , ভগিনীপ্রীতি , ধর্মপ্রাণতা , গুণগ্রাহিতা ও দানশীলতা তার চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে। সকল ধর্মের প্রতি তার উদারতা ছিল অপরিসীম। ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে, ''অশোক ও সমুদ্রগুপ্তের চারিত্রিক গুণাবলীর অপূর্ব সমাবেশ হর্ষবর্ধনের চরিত্রে দেখা যায়।''   বিজেতা , প্রজাহিতৈষী শাসক ,  সাহিত্য-সংস্কৃতির ও শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক রূপে হর্ষবর্ধন কে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি বলা যায়।

⬛অশোক ও আকবরের সাথে হর্ষবর্ধনের তুলনা :-
হর্ষবর্ধনকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশোকের সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য নিতান্তই সামান্য। অশোক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং বৌদ্ধ ধর্মের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। বৌদ্ধ ধর্মের উন্নয়ন ও তার বিস্তার কল্পে অশোক সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন মাত্র ; তিনি নিজ ধর্মের উন্নয়ন ও তার বিস্তার কল্পে কখনোই অশোকের মতো আত্মনিয়োগ করেন নি।
এছাড়াও আকবরের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের তুলনা করা হয়।  মোগল সম্রাটের মতো হর্ষবর্ধনও ছিলেন উদার ও পরধর্মসহিষ্ণু। আকবরের মত হর্ষবর্ধনও ধর্মীয় আলোচনায় আনন্দ লাভ করতেন বটে ; কিন্তু ধর্মান্ধতা কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। ইবাদত খানায় ধর্মীয় আলোচনা থেকে দীন -ই-ইলাহি ধর্মমতের    উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু হর্ষবর্ধনের ধর্মীয় আলোচনা থেকে সেরূপ কোন ধর্মের উৎপত্তি হয়নি। আকবরের মত হর্ষবর্ধনও ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী এবং জীবনের অধিকাংশ সময় তিনিও যুদ্ধ যুদ্ধবিগ্রহে অভিহিত করেন। হর্ষবর্ধনের মানবতা ও প্রজাহিতৈষণার  বিষয়টি অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় কোন কোন ঐতিহাসিকের। কেননা তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন বিস্তার ধর্মীরা রাজা এবং বাস্তববাদী রাজনীতির প্রবক্তা।  তবে কোন কোন ঐতিহাসিক হর্ষবর্ধনকে অশোকের সাথে তুলনা করার পক্ষপাতি। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো হর্ষবর্ধনের প্রজাহিতৈষী চরিত্র। অশোক ও  হর্ষবর্ধনের পুঙ্খানুপুঙ্খ সাদৃশ্য না থাকলেও প্রজাহিতৈষণা , জনকল্যাণ , সমাজকল্যান - ইত্যাদি দিক  দিয়ে অশোকের সাথে হর্ষবর্ধনের নীতিগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

⬛'' সকলোত্তরপথনাথ '' উপাধি সংক্রান্ত বিতর্ক :-
চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশী দক্ষিণ ভারতের সবথেকে শক্তিশালী শাসক  হিসেবে সপ্তম শতাব্দীতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।  হর্ষবর্ধন এক বিশাল সৈন্যবাহিনী সহ দাক্ষিণাত্য অভিযান করেছিলেন। আইহোল শিলালিপি থেকে জানা যায় যে , হর্ষবর্ধন দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতে হর্ষবর্ধনের রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। আইহোল প্রশস্তি তে হর্ষবর্ধনকে '' সকলোত্তরপথনাথ '' বলে অভিহিত করা হয়েছে। ডক্টর  মজুমদার মনে করেন যে , হর্ষের সাম্রাজ্যঃ পূর্ব পাঞ্জাব , উত্তর প্রদেশ , বিহার , বাংলার পশ্চিমাংশ এবং ওড়িশার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সমগ্র উত্তর ভারত হর্ষবর্ধন অধিকার করেছিলেন এজন্য তাকে উত্তরাপথনাথ বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু এই ধারণা ডক্টর মজুমদার খন্ডন করে দিয়েছেন। তার মতে, কাশ্মীর , পশ্চিম পাঞ্জাব , সিন্ধু , গুজরাট , রাজপুতানা , নেপাল , কামরূপ - ইত্যাদি অঞ্চল হর্ষবর্ধনের সময় স্বাধীন ছিল।  হর্ষবর্ধন থানেশ্বর , কনৌজ ও আরো কয়েকটি ছোট রাজ্যের রাজা ছিলেন। পূর্ব পাঞ্জাব , উত্তর প্রদেশের কিছু অংশ ওড়িশা রাজ্য তার অধীনস্থ হয়েছিল। ডক্টর মজুমদার তার '' Classical Age '' গ্রন্থে বলেছেন যে , হর্ষের সাম্রাজ্যকে যতটা বড় মনে করা হয় প্রকৃতপক্ষে ততটা ব্যাপ্ত  ছিল না।
যাই হোক , হর্ষবর্ধন ভারতের এক সংকটজনক মুহূর্তে থানেশ্বর ও কনৌজের সিংহাসনে বসে ছিলেন। তার চেষ্টায় কনৌজ একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর যে বিচ্ছিন্নতার শক্তি প্রাধান্য লাভ করেছিল - হর্ষবর্ধন তা দূর করে উত্তর ভারতে একটি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।  দাক্ষিণাত্যে হর্ষবর্ধনের সামরিক অভিযান  সাফল্য লাভ করেনি  ঠিকই কিন্তু  চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশী আইহোল শিলালিপিতে হর্ষবর্ধনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে '' সকলোত্তরপথনাথ '' বলে উল্লেখ করে থাকেন। হর্ষবর্ধন উত্তর উত্তর ভারতের সব রাজ্যের উপর আধিপত্য স্থাপন করতে পারেননি - বলে আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন। কিন্তু হর্ষবর্ধন উত্তর ভারতের একজন পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে  চিনা সম্রাটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এক মহা সম্মেলন বসেছিল এবং হীনযান মতের সমর্থকরা  সম্রাট হর্ষবর্ধনকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। হর্ষবর্ধনকে অনেকে ভারতের শেষ পরাক্রমশালী সম্রাট বলে মনে করেন। কিন্তু হর্ষের পরও পাল , প্রতিহার এবং রাষ্ট্রকূট রা  ভারতের শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন।
যাইহোক হর্ষবর্ধন ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ অনুসরণ  করেছিলেন তা সম্পূর্ণ সফল না হলেও সেই আদর্শ পরবর্তীকালে অন্যান্য রাজবংশ গুলিকে উৎসাহিত করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই হর্ষবর্ধনকে উত্তরাপথনাথ বা উত্তর ভারতের একচ্ছত্র অধিকারী বলাটা হয়তো সম্পূর্ণ ঠিক না হলেও পরিস্থিতির বিচারে হর্ষবর্ধনকে উত্তর ভারতের একজন বিশিষ্ট সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Share
Tweet
Pin
Share