আধুনিক বাংলা ভাষা ও তার বৈশিষ্ট।

আধুনিক বাংলার সূচনাপর্ব কোনটি ? নিদর্শন উল্লেখসহ এর ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো। 

আধুনিক বাংলা ভাষার সময়কাল ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত। কার্যত , অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্ব থেকেই আধুনিক বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন শুরু হয়। আধুনিক বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গদ্যসাহিত্যের উদ্ভব।



সেদিক থেকে বলা যায় , বাঙালির মুখের বাংলা ভাষাই এই পর্বের বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই পর্বের বাংলা ভাষার নিদর্শন বিশেষ করে গদ্যভাষার ক্ষেত্রে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকবৃন্দের রচনায় , খ্রিস্টান মিশনারিদের রচিত গ্রন্থে , রামমোহন - বিদ্যাসাগর - বঙ্কিমচন্দ্র - রবীন্দ্রনাথ - শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় পাওয়া যায়।

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিয়ে আসে নবযুগ। মধ্যযুগীয় বন্ধন কাটিয়ে শুরু হয় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জয়যাত্রা। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন এবং এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার সূত্রে বাংলা গদ্য চর্চার যে পথ তৈরী হয় , সেই পথেই আবির্ভুত হন রামমোহন রায় , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , অক্ষয়কুমার দত্ত , ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , কালীপ্রসন্ন সিংহ , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। জ্ঞানমূলক রচনার পাশাপাশি চলতে থাকে গল্প , উপন্যাস , নকশাচিত্র ও রস রচনার ধারা। বাংলার নবজাগরণ কাব্য সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিভিন্ন কাব্যের মধ্যে দিয়ে আধুনিকতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন , রচনা করেন পত্রকাব্য , সনেট এবং আধুনিক সাহিত্যিক মহাকাব্য - '' মেঘনাদবধ কাব্য ''। বাংলা নাট্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নবজাগরণের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রথম দিকে বাংলা নাট্য চর্চা শুরু হয় প্রধানতঃ ইংরেজি ও সংস্কৃত নাটকের অনুবাদের মধ্যে দিয়ে। ক্রমশ পাশ্চাত্য আঙ্গিক অবলম্বনে মৌলিক নাটক রচনার প্রয়াস শুরু হয়। এই ধারায় মধুসূদনের পথ ধরে ক্রমে আবির্ভুত হন দীনবন্ধু মিত্র , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর , গিরিশচন্দ্র ঘোষ , দ্বিজেন্দ্রলাল রায় - প্রমুখ।



আধুনিক বাংলা ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট :-
সামগ্রিক আলোচনার ভিত্তিতে আধুনিক বাংলা ভাষার বিশেষ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন -
(ক ) এই বিবর্তনের ধারার প্রথম দিকে গদ্যরীতি দুভাগে বিভক্ত ছিল - যথা - সাহিত্যিক গদ্যরীতি ও কথ্য গদ্যরীতি। সাহিত্যিকরা মূলত যে ভাষায়             
 ( সাধুভাষায় ) তাদের রচনা সৃষ্টি করতেন তাকে বলা হত সাহিত্যিক ভাষা। আর যে ভাষায় মানুষ মুখে মুখে তাদের ভাব বিনিময় করতো তাকে বলা হতো কথ্যরীতি বা চলিত ভাষা। কিন্তু ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে এই চলিত ভাষা বা কথ্য ভাষা প্রাধান্য পেতে থাকে।

(খ ) আধুনিক বাংলায় আঞ্চলিকতার গুরুত্ব বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে উপভাষা গড়ে ওঠে। ভাষাতাত্ত্বিকদের বিচারে বাংলা উপভাষা হিসাবে রাঢ়ি , বরেন্দ্রী , ঝাড়খন্ডী , বঙ্গালী , কামরূপী বা রাজবংশী - এই পাঁচটি উপভাষা গড়ে ওঠে।

(গ ) গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত রাঢ়ি উপভাষাকে ভিত্তি করে বিশেষ করে কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলে এক সর্বজনীন আদর্শ চলিত বাংলার রূপ গড়ে ওঠে।

(ঘ ) এই চলিত গদ্যরীতির সৌকর্য ও শ্রুতিমাধুর্য বৃদ্ধিতে শব্দে ধ্বনিতত্ত্বের স্বরসঙ্গতি ও অভিশ্রুতি ব্যবহারের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়।

(ঙ ) আধুনিক বাংলায় শুধু আরবি - ফারসি নয় , ইংরেজি শব্দসহ বহু বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

(চ ) প্রাচীন ছন্দরীতিকে অতিক্রম করে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ছন্দরীতি প্রচলিত হয়েছে। অতি আধুনিক কালে গদ্য ছন্দ যথেষ্ট ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ অবশ্যই অমূল্য সম্পদ। পাশ্চাত্য প্রভাবে বাংলা চতুর্দশপদী সৃষ্টি বাংলা কাব্য ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে।

(ছ ) সাম্প্রতিক কালে শব্দ উচ্চারণের পঠনরূপ ও লেখ্য রূপে পরিবর্তন এসেছে। যেমন -
মত > মতো  ;   অতিশয় > ওতিশয়  ;   নমস্কার > নমোস্কার -  ইত্যাদি।

(জ ) আধুনিক কালের বাংলায় বানান রীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন -
খ্রীষ্টাব্দ > খ্রিস্টাব্দ ;    পর্য্যন্ত > পর্যন্ত ;    শ্রেণী > শ্রেণি  ;  বাঙ্গালী > বাঙালি ;
প্রণামী > প্রণামি - ইত্যাদি।

(ঝ) সাম্প্রতিককালের লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে ( বিশেষ করে কবি ) উচ্চারণের ভিত্তিতে শব্দের বানান লেখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যা যথেষ্ট প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন -   দেখ > দ্যাখ ;  বলে ফেল > বলে ফ্যাল - ইত্যাদি।     


              

Share
Tweet
Pin
Share