গুপ্তযুগ সুবর্ণযুগ সম্পর্কিত আলোচনা।

গুপ্তযুগকে কি ভারতের সুবর্ণযুগ বলা যায় ? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও। গুপ্ত যুগ কি হিন্দু নবজাগরনের যুগ ? 

গুপ্তযুগ - ভারতের সুবর্ণযুগ : একটি তুলনামূলক আলোচনা।

ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত শাসন এক গৌরবময় অধ্যায়। গুপ্ত সম্রাটদের সামরিক প্রতিভাবলে যেমন একদিকে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর হয়েছিল তেমন অন্যদিকে তাঁদের সুদক্ষ শাসনে দেশের নিরাপত্তা বহুদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প , সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অপূর্ব বিকাশ ঘটে এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসারহেতু ভারতের অর্থনৈতিক মান উন্নত হয়। সভ্যতা - সংস্কৃতি ও শিল্পের উৎকর্ষ এই যুগকে একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছে।



ঐতিহাসিক বার্নেট গুপ্তযুগকে গ্রিসের পেরিক্লিসের যুগের সাথে তুলনা করেছেন তার ভাষায়
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পেরিক্লিস এথেন্সের নেতৃত্ব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় এথেন্সের সামরিক শক্তি আর্থিক সম্পদ ও শিল্পের উন্নতি হয়। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের অনেকেই পেরিক্লিসের যুগে আবির্ভাব হয়েছিলেন।  সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে পেরিক্লিসের যুগকে যেমন গ্রিক ইতিহাসের সুবর্ণ যুগ বলা হয় অনুরূপভাবে গুপ্তযুগকেও ভারত ইতিহাসের সুবর্ণ যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 রাজনৈতিক ঐক্য ও সুদক্ষ শাসন :-
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিশৃংখলা দেখা যায়।  প্রায় শতাব্দীকাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশের কোন সার্বভৌম শক্তির অভ্যুত্থান ঘটেনি। পশ্চিমে কুষান ও শকরা এবং উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বহু ক্ষুদ্র রাজারা রাজত্ব করছিলেন। এইসব রাজ্যগুলির পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে গুপ্ত রাজাদের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের উত্থান ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।  ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর করে গুপ্ত রাজারা সর্বভারতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রে উন্নত ধরনের সভ্যতা রচনা করেন।  তাঁরা প্রায় দুইশত বছর ধরে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বজায় রাখতে সমর্থ হন। গুপ্তরাজাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভা বলে একে একে পল্লব কুষাণ রাজ্যগুলি বিলুপ্ত হয় ,রাষ্ট্রীয় ঐক্য পুনঃস্থাপিত হয় এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয়।  গুপ্ত রাজাদের কৃতিত্ব শুধু রাজ্য বিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না ; প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা দক্ষতার পরিচয় দেন। সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়েও রাজা ছিলেন প্রজাহিতৈষী। ফা হিয়েন প্রমুখ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীতে রাজাদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও উন্নত শাসন ব্যবস্থার প্রচলন হেতু দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নত হয়েছিল।



অর্থনৈতিক উৎকর্ষ :-
মুদ্রা, লিপি ও ফা হিয়েন এর বিবরণ থেকে গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। এই যুগে সর্বত্র বহু নগরীর প্রতিষ্ঠা অর্থনৈতিক উৎকর্ষের সাক্ষ্য বহন করে। এই যুগের নগর গুলির মধ্যে প্রধান ছিল মগধ ,ইন্দ্রপুর , চন্দ্রপুর ,অযোধ্যা ,পাটলিপুত্র ইত্যাদি। নগর পরিকল্পনা ও সেগুলির জনকল্যাণমূলক কার্যকলাপের বর্ণনা থেকে যথাক্রমে শিল্পকলার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আভাস পাওয়া যায়।
 গুপ্ত যুগের কৃষি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ উন্নতি লাভ করে। কৃষি ছিল অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। কৃষি উন্নয়নের প্রতি রাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি ছিল। এই যুগের সাহিত্যের চৌষট্টি রকমের শিল্পের উল্লেখ রয়েছে।  এগুলির মধ্যে ধাতু শিল্প ,বস্ত্র শিল্প - ইত্যাদি প্রধান ছিল। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করত।  আবার কোথাও ব্যবসায়ীদের নিয়ে শ্রেষ্ঠী , সার্থবাহ বণিকসংগঠনগুলি গঠিত হতো। এগুলি অনেকটা আধুনিককালের চেম্বার অব কমার্সের কার্যসম্পাদন করতো।
 দেশীয় শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিগমের পরিচালনাধীন ছিল। এই যুগে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈশালী ,কোটিবর্ষ প্রভৃতি বাণিজ্যকেন্দ্র গুলিতে ব্যাঙ্কগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। গুপ্ত যুগের স্বর্ণ ,রৌপ্য ,তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন ছিল। গুপ্ত যুগের সামুদ্রিক বাণিজ্য যথেষ্ট উন্নত ছিল। সৌরাষ্ট্র ,আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত বন্দরগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্য ভুক্ত হওয়ায় সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। এই যুগের বন্দর গুলির মধ্যে তাম্রলিপ্ত , কয়াল , ব্রোচ , সোপারা -  প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ছিল। ব্রহ্মদেশ , পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ , চীন , পারস্য প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য চলত।  বহির্বিশ্বের সাথে পণ্য বিনিময়ের   ফলে ভারতের অর্থনৈতিক মান বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এই বাণিজ্য পথ ধরেই ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিদেশে প্রসার লাভ করেছিল।



সামাজিক ব্যবস্থা :-
গুপ্ত যুগের হিন্দুসমাজ চারটি বর্ণ বা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল - যথা ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ও শূদ্র। রাজা ছিলেন প্রধান সমাজপতি। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সংমিশ্রণ প্রতিরোধ করা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। সমাজ জীবনে ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল শীর্ষে এবং তাদের কর্তব্য ও আদর্শ সুনির্দিষ্ট ছিল। সমাজে বর্ণভেদ প্রথা কঠোর হলেও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। বহুবিবাহ সমাজে প্রচলিত ছিল। গুপ্ত রাজপরিবারের বহুবিবাহের উল্লেখ আছে। অবশ্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে একমাত্র রাজার প্রধানা মহিষী অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতেন। সে যুগে স্ত্রী ধনেরও উল্লেখ পাওয়া যায় এবং নারীরা ইচ্ছামত দান করতে পারতেন। সমাজে সতী প্রথা প্রচলিত ছিল এবং নারী শিক্ষার বহুল প্রচলন ছিল। নারী শিক্ষার জন্য শিক্ষায়তনের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য রাজপরিবার ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাই  উচ্চশিক্ষা লাভ করত। নারী স্বাধীনতা ছিল এই যুগে অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কথাসরিৎসাগর নামক গ্রন্থ থেকে সে যুগে অভিজাত ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার  পরিচয় পাওয়া যায় এমনকি নারীরাও মদ্যপানের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন না।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি : পেরিক্লিসের যুগের সাথে তুলনা :-
গুপ্তযুগে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অপূর্ব বিকাশ ঘটে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে বিচার করে বার্নেট গুপ্তযুগকে গ্রিসের পেরিক্লিসের যুগের সাথে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে স্মিথ গুপ্তযুগকে ইংল্যান্ডের এলিজাবেথ ও স্টুয়ার্ট যুগের সাথে তুলনা করেছেন। গুপ্ত সম্রাটদের অনেকেই বিদ্যোৎসাহী ও সংস্কৃতির পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।  সমুদ্রগুপ্ত কেবল শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন তাই নয় , তিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন। যদি কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত অভিন্ন হন , তাহলে তাকে প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বলা যেতে পারে। স্মিথের মতে , প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতের ভাব - আদর্শের বিনিময়ের ফলেই ভারতীয় মনীষার এক অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল।

সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রচলন :-
গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের বিশেষ উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। গুপ্ত পূর্ববর্তী যুগগুলিতে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন থাকলেও তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি। কিন্তু গুপ্ত রাজারা সংস্কৃত সাহিত্য ও ভাষার পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় তাঁদের অনুগ্রহে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উত্তরোত্তর এবং অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এই যুগের লিপিগুলি অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় লেখা।
এই যুগে মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণগুলির সম্পাদনার কাজ সম্পন্ন হয়। এর ফলে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধিত হয়। জাতীয় স্বার্থে গুপ্তযুগে -ভাগবৎ , স্কন্দ , মৎস , বায়ু ও ব্রম্মান্ডপুরান নতুন করে রচিত হয়।
গুপ্তযুগে  বহুসংখ্যক খ্যাতনামা সাহিত্যিক , কবি ও দার্শনিকদের আত্মপ্রকাশ হয়। এদের মধ্যে কালিদাস ছিলেন অন্যতম। কালিদাস রচিত  - শকুন্তলা , মেঘদূত , কুমারসম্ভব , ঋতু সংহার , মালবিকাগ্নিমিত্রম - প্রভৃতি নাটকগুলি বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এছাড়া , শুদ্রকের মৃচ্ছকটিক , বিশাখাদত্তের মুদ্রারাক্ষস , বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র - ইত্যাদি গ্রন্থগুলিও ভারতীয় সাহিত্য উৎকর্ষতাকে প্রমাণিত করে।
এছাড়া সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন কর্তৃক রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে গুপ্ত রাজাদের শাসন প্রণালী সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়াও এই যুগে বৌদ্ধ দর্শনিকেরাও শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। বসুবন্ধু রচিত হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধ দর্শন গ্রন্থ , প্রমর্থ রচিত বসুবন্ধুর জীবনী - ইত্যাদি গ্রন্থগুলিও ভারতীয় সাহিত্যের অমূল্য নিদর্শন। 

  এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


বিজ্ঞানে অগ্রগতি :-
সাহিত্য ছাড়াও জ্যোতিষ, গণিত ,রসায়ন প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভারতীয় মনীষার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। আর্যভট্ট , বরাহমিহির ছিলেন এই যুগের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। আর্যভট্ট রচিত সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের কারণের  মনোরম বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি গ্রহ - উপগ্রহ গুলির অবস্থিতি সম্পর্কে বিবরণ রেখে গেছেন।  বরাহমিহির রচিত বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে গ্রিক ও রোমান জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এরূপ অনুমান করা যেতে পারে যে ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা রোমান  সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত ছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রর এই যুগে যথেষ্ট প্রসার ঘটে এবং সম্ভবত শল্যচিকিৎসা এই যুগে প্রচলিত ছিল এবং অনেকের মতে শল্যবিদ্যাতে পারদর্শী সুশ্রুত গুপ্ত যুগেই  প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

শিল্পকলা :-
গুপ্ত যুগে স্থাপত্য ,ভাস্কর্য ও চিত্রকলা অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করে।  এই যুগে মথুরা ,  বারাণসী ও পাটলিপুত্র  শিল্পকলার প্রধান কেন্দ্র ছিল। গুপ্ত যুগের শিল্পকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সহজ ও স্বাভাবিক গঠন এবং সৌন্দর্য প্রকাশ। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ ও ধর্ম সম্বন্ধীয় ঘটনাবলীকে অবলম্বন করে ভাস্কররা তাদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। এই যুগের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলি মুসলমান আক্রমণের ফলে বিধ্বস্ত হওয়ায় এগুলির বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। এই যুগের আবিষ্কৃত স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন হলো   তিগোয়ার বিষ্ণু মন্দির, ভূমারের  শিবমন্দির , কুবীরের পার্বতী মন্দির সাঁচী ও বৌদ্ধগয়ার বৌদ্ধ স্তুপ ইত্যাদি ভিতরগাঁওয়ের ইষ্টকনির্মিত মন্দির - ইত্যাদি।  ভিতরগাঁওয়ের ইষ্টকনির্মিত মন্দির ছিল পিরামিডের মতো।
ভাস্কর্য শিল্পেও  গুপ্তযুগে অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ ধর্ম সম্বন্ধীয় ঘটনাকে অবলম্বন করে ভাস্কররা শিল্পের পরিচয় দেন। সারনাথে প্রাপ্ত ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ , মথুরায় প্রাপ্ত দণ্ডায়মান বুদ্ধ ,সুলতানগঞ্জের প্রাপ্ত বুদ্ধের তাম্রমুর্তি বৌদ্ধ ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।  ভারতের কতগুলি শ্রেষ্ঠ শিবমূর্তি গুপ্ত যুগে নির্মিত হয়েছিল। গুপ্ত যুগে চিত্রশিল্পের ও অপূর্ব বিকাশ ঘটে। পাহাড় কেটে গুহা মন্দির নির্মাণ ও মন্দিরের দেয়ালে অঙ্কিত চিত্র সেযুগের চিত্রশিল্পের চরম উৎকর্ষ সাক্ষ্য বহন করে। অজন্তা গুহা চিত্রের অধিকাংশই এই যুগের সৃষ্টি এবং ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে এই চিত্রগুলি রেনেসাঁ যুগে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠ প্রাচীন চিত্রের সমতুল্য। গুহাচিত্র গুলি বাস্তবতায় পরিপূর্ণ এবং এগুলিতে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর নরনারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছে। বুদ্ধের জীবনী অবলম্বনে বহু চিত্তাকর্ষক চিত্র অঙ্কিত হয়।  দিল্লির কুতুব মিনারের নিকট প্রাপ্ত ধাতব স্তম্ভ এই যুগের ধাতব শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। দেড় হাজার বছর পরেও সূর্যতাপ ও বারিপাতে তাতে এখনো মরিচা পড়ে নি। এছাড়া নালন্দায় প্রাপ্ত বুদ্ধের তাম্রমুর্তি ও সুলতানগঞ্জে প্রাপ্ত অপর একটি মূর্তি সেই যুগের ধাতব শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।       

ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা :-
গুপ্তরাজারা ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক ; কেননা তাঁরা নিজেদের ''পরমভাগবৎ '' বলে অভিহিত করতেন। এছাড়াও গুপ্ত রাজাদের প্রচলিত মুদ্রায় বিষ্ণু পত্নী লক্ষীর ও বিষ্ণুর বাহন গরুড় এর প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত থাকতে দেখা যায়।
তবে কিছু গুপ্ত মুদ্রাতে শিবের বাহন বৃষের প্রতিচ্ছবিও দেখা যায়। এ থেকে মনে করা হয় তারা শিবেরও উপাসক ছিলেন। আবার কতকগুলি মুদ্রায় পার্বতী , কার্তিকেয় প্রমুখ দেব দেবীর ছবিও অঙ্কিত দেখা যায়। সুতরাং , বলা যায় গুপ্ত রাজারা ছিলেন হিন্দুধর্মী এবং বিভিন্ন দেব দেবীর উপাসক। শিব ও বিষ্ণু মন্দিরের বহু নিদর্শন গুপ্ত সভ্যতায় দেখা যায়। শিব পূজার সঙ্গে সঙ্গে পার্বতীর পূজারও প্রচলন ছিল। মহিষাসুরমর্দিনীর বহু মূর্তি গুপ্ত সাম্রাজ্যের নানা স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে।

গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের সাথে সাথে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মও প্রচলিত ছিল। হিন্দুধর্ম রাজধর্ম হলেও ফা - হিয়েনের বিবরণীতে বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তার কথা জানা যায়। এই যুগের শিক্ষা সংস্কৃতির বিস্তারে বৌদ্ধাচার্য ও বৌদ্ধ - গ্রন্থকারদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। নাগার্জুন , বসুবন্ধু , পরমার্থ প্রমুখ বৌদ্ধ মনীষীদের আবির্ভাব এই যুগেই হয়েছিল। ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিল গুপ্ত রাজত্বের এক প্রধান বৈশিষ্ট। শাসনকার্যে অ - হিন্দু ব্যাক্তিদেরও নিযুক্ত করা হতো। ফা - হিয়েনের বিবরণী থেকে জানা যায় যে , হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল। ধর্মীয় বিভেদের কোনো প্রমান এ যুগে পাওয়া যায় নি।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যেতে পারে , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা প্রচলিত থাকায় গুপ্তযুগে সার্বিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এদিক দিয়ে বিচার করলে গুপ্ত যুগকে সুবর্ণযুগ বলাটা অযৌক্তিক নয়। তবে ভিন্নমতও বর্তমান। কিছু কিছু ঐতিহাসিকের মতে , আর্থিক সুযোগ সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা সমাজের উচ্চকোটির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই সুবর্ণযুগের ধারণা কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়। তবে সামগ্রিক ভাবে গুপ্ত আমলে সার্বিক অগ্রগতির জন্য একে সুবর্ণযুগ বলা যেতে পারে।       

 এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।



গুপ্তযুগ হিন্দু নবজাগরণের যুগ কি'না - সে বিষয়ক আলোচনা। 
 একদল ঐতিহাসিক গুপ্তযুগকে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতির নবজাগরণের যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইউরোপের ইতিহাসে Renaissance বলতে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য , দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোচনা এবং ইউরোপীয় মনীষার পুনর্জন্ম বোঝায়। ইউরোপের ইতিহাসে এই সাংস্কৃতিক বিকাশ রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে প্রসিদ্ধ। ভারতের একদল ঐতিহাসিকের মতে , গুপ্তযুগ ছিল হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির নবজাগরণের যুগ। এই মতবাদের পেছনে তাঁদের যুক্তি হলো -
প্রথমতঃ বৈদিক যুগ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকাল পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অভাবনীয় বিকাশ ঘটে। কিন্তু অশোকের রাজত্বকাল থেকে বৌদ্ধধর্ম রাজ - পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় হিন্দুধর্মের প্রভাব বিশেষভাবে হ্রাস পায়।

দ্বিতীয়তঃ বৌদ্ধধর্ম রাজধর্মে পরিণত হলে এবং ভারতের বাইরে ও অভ্যন্তরে এর ব্যাপক প্রসার ঘটায় ভারতে হিন্দুরা একটি নগন্য ধর্ম - সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।

তৃতীয়তঃ অশোকের সময় থেকে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে পালি ভাষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হলে বৈদিক ধর্মের প্রধান বাহন সংস্কৃত ভাষা স্থবির হয়ে পড়ে।

তবে এর বিপরীত মতামতও লক্ষ্য করা যায়। বিপরীত যুক্তিগুলি হলো - 
প্রথমতঃ অশোকের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম রাষ্ট্রীয় তথা বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছিল এবং হিন্দুধর্ম জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল - একথা সত্য , কিন্তু তাই বলে একথা স্বীকার করা যায় না যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ফলে হিন্দুধর্ম  মুমুর্ষ হয়ে পড়েছিল।

দ্বিতীয়তঃ অশোক ও কনিস্ক উভয়েই পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। তাঁদের আমলে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা যায় নি। অশোক ও কনিস্ক উভয়ই শাসনকার্যে উচ্চপদে বহু হিন্দু নিয়োগ করেছিলেন। 

তৃতীয়তঃ শুঙ্গরাজারা ও সাতবাহনরা উভয়ই ছিলেন ব্রাম্মধর্মাবলম্বী। তাদের আমলে হিন্দু ধর্ম পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

চতুর্থতঃ শক - ক্ষত্রপ ও কুষাণ রাজাদের অনেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন ; কিন্তু হিন্দু দেব দেবীর প্রতিও তাঁরা সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রুদ্রদামনের গিরনার লিপি সংস্কৃতে রচিত।

পঞ্চমতঃ মহাযান বৌদ্ধমতের উদ্ভব ঘটলে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পার্থক্য অনেকটা দূর হয়। মহাযান ধর্মাবলম্বীরা সংস্কৃত ভাষায় তাঁদের ধর্মশাস্ত্র রচনা করতেন।

সামগ্রিক ভাবে বলা যায় , অশোকের সময় থেকে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা কিছুটা ম্লান হয়ে পড়েছিল মাত্র , কিন্তু গুপ্তদের আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্ম পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সুতরাং , নিঃসন্দেহে বলা যায় , কোনো যুগেই হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার বিলোপ ঘটেনি। গুপ্তদের হাত ধরে তা আরো শক্তিশালী হয়েছিল মাত্র।          


  

Share
Tweet
Pin
Share