উদারনীতিবাদ : সংক্ষিপ্ত ধারণা :-

উদারনীতিবাদের ধারণাটি বিশ্লেষণ করো। এর মূলনীতি বা মূল সূত্রগুলো আলোচনা করো। 

উদারনীতিবাদ : সংক্ষিপ্ত ধারণা :- 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, উদারনীতিবাদ হলো এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতি রূপে সমাজ গঠনের নীতি রূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শ রূপে স্বাধীনতা কে প্রতিষ্ঠা করে। উদারনীতিবাদের ব্যক্তি কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।  উদারনীতিবাদ মনে করে আগে ব্যক্তি পরে রাষ্ট্র। এই তত্ত্ব  অনুযায়ী , ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র ; রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়। উদারনীতিবাদের মোট তিনটি ধারা রয়েছে সেগুলি হল -
১. সাবেকি উদারনীতিবাদ
২.আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদ
এবং ৩. নয়া উদারনীতিবাদ।

উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে  হবহাউস তার  Liberalism গ্রন্থে  বলেছেন , ব্যক্তিত্বের আত্ম পরিচালনার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সমাজ গঠনের আদর্শকে উদারনীতিবাদ বলে। 



উদারনীতিবাদের মূলনীতি :- 

সামগ্রিকভাবে উদারনীতিবাদের মূল নীতি হলো -
1. আইনের শাসন :-
উদারনৈতিক মতবাদ আইনের শাসনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পৌর ও ব্যেক্তিস্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য আইন কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে এই দর্শনের প্রবক্তাগণ মনে করেন।

2. শাসিতের সম্মতি :-
শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উদারনৈতিক মতবাদে  সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হয়।

3. অবাধ বাণিজ্য নীতি :-
উদারনৈতিক মতবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্য নীতিকে স্বীকার করে।  এডাম স্মিথের মতে , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হয়।



4. স্বাধীনতা :-
উদারনৈতিক মতবাদে স্বাধীন চিন্তা , স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা গুলিকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়।  এছাড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলা হয়।

5. আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতা :-
জাতিগত সাম্য , আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার , আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযোগিতাকে উদারনৈতিক মতবাদে স্থান দেওয়া হয়েছে।

6. রাজনৈতিক সাম্য :-
উদারনৈতিক মতবাদে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  এ জন্য জনগণের শাসন বা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। জনগণের শাসন বলতে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাকে বোঝায়।

7. পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি :- 
উদারনৈতিক মতবাদে নাগরিকদের পৌর এবং রাজনৈতিক অধিকার গুলি কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার ,  চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার , ধর্মের অধিকার , নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার , পরিবার গঠনের অধিকার -  ইত্যাদি।

 8. সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন :- 
উদারনৈতিক মতবাদে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সরকার পরিবর্তন স্বীকৃত হয়েছে।  এজন্য বৈপ্লবিক হিংসাত্মক পথের প্রয়োজন হয়না।



9. আইনের দৃষ্টিতে সাম্য :- 
আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়টি উদারনৈতিক মতবাদ স্বীকৃত হয়েছে। আইনের অনুশাসনের মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

10. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা :- 
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সংরক্ষণ করে। এছাড়া আদালত দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক রূপে কাজ করে।

11. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার :- 
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ স্ত্রী-পুরুষ ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমান ভাবে ভোটদানের অধিকার স্বীকৃত হয়।

 12 . জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি :- 
আধুনিক সংশোধনমূলক উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে গতিশীল কর ব্যবস্থা , শিল্প বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ , ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়করণ - প্রভৃতির কথা বলা হয়।

13.বহুদলীয় ব্যবস্থা :-
আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদের প্রবক্তাগণ বহুদলীয় ব্যবস্থা কে রাষ্ট্রের পক্ষে আদর্শ বলে মনে করে থাকেন। তাদের মতে জনগণের বহুমুখী আশা-আকাঙ্খার রূপায়ণ বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব।

14.ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি :-
উদারনীতিবাদের দার্শনিকেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি দেন। তাদের মতে , নাগরিকদের হাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তারা কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।

15. ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা :-
উদারনীতিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী রাষ্ট্র সর্বস্ব ফ্যাসিবাদের তীব্র বিরোধী। ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের একদলীয় একনায়কের শাসন , ব্যক্তিপূজা , অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ , জাতিবিদ্বেষ   আগ্রাসী যুদ্ধনীতি ইত্যাদিকে উদারনীতিবাদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়।

16. বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা :-
 উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের বদলে বহুত্ববাদী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের পারস্পরিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেতে পারে।

17. নূন্যতম রাষ্ট্র :- 
নয়া উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকা পরিবর্তন ঘটানো হয়। অতি ক্ষমতাশালী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে এক ন্যূনতম বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণা কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। নয়া উদারনীতিবাদ অনুসারে নিরাপত্তা রক্ষা , ন্যায় বিচার এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
18.পুঁজির বিশ্বায়ন :- 
নয়া উদারনীতিবাদ সারা বিশ্বজুড়ে পুঁজির অবাধ চলাচলের পক্ষপাতী।

19. মুক্তবাজার অর্থনীতি :-
 নয়া উদারনীতিবাদে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

উপসংহার :-
সমালোচকরা উদারনীতিবাদকে রক্ষণশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর রাষ্ট্রদর্শন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও ভোগবাদী মৌলবাদের দর্শন রূপে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এই মতবাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যে অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এটি বিবর্তিত হয়েছে।  তাছাড়া ভবিষ্যৎ সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের গতি প্রকৃতির একটি প্রতিচ্ছবিও এই মতবাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এজন্য আজকের বিশ্বায়নের দুনিয়ায় উদারনীতিবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

Share
Tweet
Pin
Share