ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সাম্যের অধিকারগুলি আলোচনা করো।

ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সাম্যের অধিকারগুলি আলোচনা করো। 

ভারতীয় সংবিধানের স্বীকৃত অধিকার সমূহের মধ্যে সাম্যের অধিকার বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। সংবিধানের  প্রনেতাগণও সাম্যের আদর্শের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। প্রস্তাবনায় মর্যাদা এবং সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্যের নীতি ঘোষিত হয়েছে। সংবিধানের 14 থেকে 18 নং ধারায় সাম্যের অধিকার যুক্ত আছে। সাম্যের অধিকার বলতে শুধুমাত্র সকলের জন্য সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা কে বোঝায় না ; প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ , মৌল দাবি দাবি পূরণ না হলে মানুষ হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় - তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করাই  সাম্যের অধিকারের মর্মবস্তু বলে বিবেচিত হয়। এই অধিকার এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। সাম্যের অধিকার বলতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ জন্মস্থান, ধনী-নির্ধন এবং স্ত্রী - পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের আত্মবিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক সুযোগ-সুবিধা এবং দাবির স্বীকৃতি কে বোঝায়। সাম্যের অধিকার ব্যতীত স্বাধীনতার অধিকার পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনা। যে সমাজে বিশেষ শ্রেণীর জন্য সুযোগ সুবিধা ব্যবস্থা থাকে সেখানে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে।



1 . আইনের দৃষ্টিতে সাম্য এবং আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার :- 

সংবিধানের 14 নং ধারায় বলা হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্র আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার  এবং আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবেনা।  এর অর্থ হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা ,  রাজনৈতিক ক্ষমতা , শ্রেণী , বর্ণ, জাতপাত , জন্মস্থান -  নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকই রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার ও সমমর্যাদার অধিকারী এবং আইন সকলকে সমভাবে রক্ষা করবে।

যদিও সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছে।  যেমন :-
প্রথমত -  রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল কে পদে থাকাকালীন অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগ এবং কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আদালতে জবাবদিহি করতে হয় না। পদে থাকাকালীন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না।
দ্বিতীয়ত -  আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুযায়ী , রাষ্ট্রদূত এবং বিদেশী দূতাবাসের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা দায়ের করা যায় না। 
তৃতীয়তঃ শিল্প বিরোধ সহ কয়েকটি বিষয় নিষ্পত্তির জন্য তা  সাধারণ আদালতে পেশ করা হয় না।  যেমন পাঞ্জাবের উগ্রপন্থীদের জন্য স্বতন্ত্র আদালত গঠিত হয়েছিল।
চতুর্থত -  ভারতীয় ফৌজদারি বিধির 197 নং ধারা অনুসারে কর্তব্য পালনের সময় বিশেষ সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিরা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষেত্রে যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের অনুমতি প্রয়োজন।
পঞ্চমতঃ - বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় অনুশাসন ভিত্তিক আইন প্রণয়ন করা যায়। যেমন 1986 সালে প্রণীত মুসলিম মহিলা আইন।



 2 . বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান :- 

সংবিধানের 15 নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে জাতি ,  ধর্ম - বর্ণ এবং জন্মস্থান প্রভৃতি কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্র কোনোরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহৃত কোন দোকান , হোটেল-রেস্তোরাঁ , স্নানাগার , পুষ্করিণী এবং অন্যান্য প্রমোদমূলক ও প্রয়োজনীয় স্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রভৃতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোন বিভাজন করবে না এবং কোন বিভেদ মূলক আচরণ করবে না।
তবে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্র বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ওইসব স্থানে ছোয়াঁচে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার বাধা দিতে পারে ; স্ত্রী লোক ,  তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের উন্নতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

3 . সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সমানাধিকার :-

সংবিধানের 16 নং ধারায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সকল ভারতীয় নাগরিকদের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে যে , জাতি-ধর্ম-বর্ণ , বংশ , জন্মস্থান , স্ত্রী - পুরুষ ভেদে কোন নাগরিককে রাষ্ট্রের অধীনে চাকরির জন্য অনুপযুক্ত বলে গণ্য করা যাবে না।
কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যেমন -
সরকারের অধীনে চাকরির ক্ষেত্রে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী এবং বিশেষ করে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ সংরক্ষণ রাখতে পারে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকতে পারে।
কোন রাজ্য সরকারের অধীনে চাকরির জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যে বসবাসের যোগ্যতাকে একটি শর্ত হিসেবে আরোপ করা যেতে পারে - ইত্যাদি।



4 . অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ :-

ভারতীয় সমাজে দীর্ঘ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে সামাজিক ব্যাধি সংখ্যাগুরু মানুষের জীবনকে জর্জরিত করে তুলেছে তাহল জাতিভেদ প্রথা। মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাগন উপলব্ধি করেছিলেন যে , অস্পৃশ্যতার মত সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টিকারী আচরণের অবস্থান বর্তমান থাকলে  সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই কারণে তারা তাঁরা সংবিধানে 17 নং ধারাটিকে যুক্ত করেন। 17 নং ধারায় উল্লেখ আছে যে , কোনো রকম অস্পৃশ্যতামূলক আচরণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এরপর 1955 সালে সংসদে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এই আইনের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতামূলক আচরণকে শাস্তিমূলক আচরণের আওতায় আনা হয়।

5. উপাধি বা খেতাবের বিলোপ সাধন :- 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন বিশেষ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ব্যাক্তির অস্তিত্ব কাম্য নয়।  কারণ এর ফলে সকলের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা আদর্শ অবহেলিত হয় ও বৈষম্যের উদ্ভব ঘটে। এই কারণে সংবিধানের 18 নং ধারায় বিশেষ সামাজিক মর্যাদা সূচক খেতাব প্রদান এবং তার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  রাষ্ট্র সামরিক এবং বিদ্যা সংক্রান্ত স্বীকৃতি ছাড়া অন্য কোন কারণে খেতাব দিতে পারে না। তবে 1954 সাল থেকে সামাজিক ,শিক্ষা ,সংস্কৃতি, চিকিৎসা বিজ্ঞান , বিজ্ঞান , সামরিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ভারতীয় নাগরিকদের ভারতরত্ন ,পদ্মভূষণ,পদ্মশ্রী , পদ্মবিভূষণ প্রভৃতি খেতাব ভারত সরকার দিয়ে আসছেন। 1977 সালে জনতা পার্টির সরকার ওইসব উপাধি প্রদান বাতিল করে দেন। কিন্তু 1980 সালে ইন্দিরা গান্ধি পুনরায় ক্ষমতাসীন হলে উপাধি প্রদান পুনরায় শুরু হয়।

তবে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে এইসব উপাধিগুলি বাস্তবে কোন উপাধি বা খেতাব নয়। এগুলি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মানসূচক স্বীকৃতি মাত্র ; এতে সামাজিক বৈষম্য বিনষ্ট হওয়ার কোন অবকাশ নেই। তবে ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকার এর সমালোচনা করে বলা হয়  যে , এই অধিকার আংশিক ও খন্ডিত। এই অধিকার মূলত আইনগত। প্রকৃতঅর্থে , অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তাই হ্যারল্ড ল্যাস্কি সঠিক ভাবে উল্লেখ করেছেন যে , যেখানে সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকে সেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ থাকতে পারে না। 

Share
Tweet
Pin
Share