দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি দাও।
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি দাও।
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলোচনা কর।
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি :-
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম হলেন - লর্ড ব্রাইস , গেটেল , মিল , হেনরি মেইন - প্রমুখ। দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তিগুলি হল -
১. নিম্নকক্ষের স্বৈরাচারি মানসিকতা প্রতিরোধ :-
আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে আইনসভার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু আইনসভাতে শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে , তাই শাসক দল নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে যেকোনো ধরণের আইন প্রণয়ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় থাকে না। তাই নিম্নকক্ষের স্বৈরাচারি মানসিকতা প্রতিরোধে আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হওয়াই কাম্য।
২. সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন সম্ভব :-
আইনসভার উচ্চ কক্ষ হল জ্ঞানীগুণী মানুষদের সমাবেশ। তাই যেকোনো ধরণের আইন প্রণয়ন করার সময় উচ্চ কক্ষের বিশেষজ্ঞরা সেই সকল প্রস্তাবিত আইন গুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন ও প্রয়োজনে তার পরিবর্তন করতে পারেন। তাই সুচিন্তিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অধিক কার্যকর।
৩. সদস্যদের যোগ্যতা :-
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা জনগণ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত হন। তাঁরা দক্ষ রাজনীতিবিদ হলেও আইন প্রণয়নের যে সকল যোগ্যতা ও দক্ষতা দরকার হয় , অনেক সময় তা জনপ্রতিনিধিদের থাকেনা। কিন্তু আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায় ; কেননা কেবলমাত্র জ্ঞানীগুণী মানুষদেরকেই উচ্চকক্ষের সদস্যপদ দেওয়া হয়।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত :-
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয় ও প্রাদেশিক স্বার্থ সুরক্ষিত হয় দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা দ্বারা। কিন্তু আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে প্রাদেশিক স্বার্থগুলি উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা উপযুক্ত।
৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পক্ষে উপযুক্ত :-
আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হলে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু উচ্চকক্ষে পরোক্ষভাবে নির্বাচন হয় , তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আইনসভাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য পাঠাতে পারে। এইসকল সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন - যার ফলে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়।
৬. রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার সম্ভব :-
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাতে যেহেতু শুধুমাত্র শাসক দলের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় , তাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক - বিতর্ক , আলোচনা - ইত্যাদির কোনো অবকাশ থাকেনা। কিন্তু দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাতে বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক - বিতর্ক ও আলোচনা সংগঠিত হয়। সেগুলি দূরদর্শনে ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ঘটে।
৭. উৎকর্ষতা :-
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চ কক্ষের সদস্যরা অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক , সামাজিক পরিবর্তন , শিক্ষা , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি - ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ - সে বিষয় প্রশ্নাতীত। উচ্চকক্ষের জ্ঞানীগুণী সদস্যরা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে উৎকর্ষ কেন্দ্রে পরিণত করে ।
৮. আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত :-
আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের পরিবর্তে জনকল্যাণের কাজেই বেশি আগ্রহী। সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তার , নারী ও শিশু কল্যাণ , গ্রাম ও শহর উন্নয়ন , কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মপরিধির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই আইনসভার শুধুমাত্র একটি কক্ষের পক্ষে এইসকল বহুমুখী কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয় - সেক্ষেত্রে দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা কাম্য।
৯. বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত :-
একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে সর্বদা জাতি , ভাষা , সংস্কৃতি , উন্নয়ন - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকে। তাই এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে সেই বিপুল ভিন্নতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে আঞ্চলিক স্বার্থগুলিও ভিন্ন ভিন্ন হয় - যা এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে সফলভাবে পূর্ণ করা সম্ভব হয়না। তাই বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা উপযুক্ত।
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি :-
১. উচ্চ কক্ষ গণতান্ত্রিক নয় :-
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের সদস্যদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের কোনো ভূমিকা থাকেনা। তাঁরা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলগুলি দ্বারা নির্বাচিত হন। তাই , গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হলে দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গণতান্ত্রিক নয়।
২. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয় :-
আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে - আইন প্রণয়ন , আইন পরিবর্তন , সিদ্ধান্ত গ্রহণ - ইত্যাদি কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে করা যায়। কেননা , দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের মধ্যে মতবিরোধ তৈরী হলে সিদ্ধান্তগ্রহনের ক্ষেত্রে অযথা বিলম্ব হয়।
৩. জরুরি অবস্থার পক্ষে উপযুক্ত নয় :-
আপৎকালীন সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় যেহেতু দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় , তাই জরুরি অবস্থার সময় এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অনেক বেশি কার্যকর। কিন্তু , দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাতে আলোচনা , মতবিরোধ - ইত্যাদির ফলে যথেষ্ট বিলম্ব হয় যা জরুরি অবস্থার পক্ষে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য নয় :-
হ্যারল্ড ল্যাস্কি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকেই উপযুক্ত বলে দাবী করেছেন। তাঁর মতে , প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টিত হয় সংবিধান দ্বারা। তাই , প্রাদেশিক সরকারগুলির স্বার্থ রক্ষার জন্য উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন।
৫. ব্যায়ভার বেশি :-
আইনসভায় দুটি কক্ষ থাকলে বহুসংখ্যক সদস্যদের জন্য আর্থিক ব্যয় প্রচুর হয়। কিন্তু এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সেই ব্যায়ভার অনেকটা কমিয়ে ফেলা যায় এবং সেই অর্থ জাতীয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কার্যে ব্যয় করা যেতে পারে।
৬. উচ্চ কক্ষের অস্তিত্ব অর্থহীন :-
দ্বি - কক্ষ আইনসভাগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উচ্চ কক্ষে শাসক দলের প্রতিনিধিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকেন। ফলে তাঁরা সরকারের নীতি , সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির নির্দ্বিধায় সহমত পোষণ করেন। আবার , সমক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ কক্ষগুলিতে বিরোধীদের প্রবল বিরোধিতায় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৭. সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার সঙ্গে উচ্চ কক্ষের ভূমিকা সম্পর্কহীন :-
কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে , আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হলে উচ্চ কক্ষ সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এরূপ ধারণার কোনো যৌক্তিকতা নেই ;কেননা , সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয় সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা , সরকারের সদিচ্ছা - ইত্যাদির ভিত্তিতে। এর সঙ্গে আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
৮. জনমতের ইচ্ছার প্রকৃত প্রকাশ ঘটেনা :-
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চ কক্ষের সদস্যরা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে জ্ঞানীগুণী ও পন্ডিত হলেও তাঁদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকেনা। ফলে জনগণের চাহিদা , আশা - আকাঙ্খা - ইত্যাদি বিষয় অনুধাবন করতে অনেকসময় তাঁরা ব্যর্থ হন। এছাড়াও , শাসক দলের চাপে উচ্চ কক্ষের সদস্যরা সহমত পোষণ করতে থাকলে উচ্চ কক্ষের অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে।
0 comments