­
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি দাও। - NANDAN DUTTA

এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি দাও।

by - April 11, 2025

এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি দাও। 

এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলোচনা কর।  




এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি :- 


এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম হলেন - জেরেমি বেন্থাম , ল্যাস্কি , আবে সিয়ে - প্রমুখ। এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তিগুলি হল - 

১. গতন্ত্রের পক্ষে উপযুক্ত :- 
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক। কেননা , এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সদস্যরা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। পক্ষান্তরে দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের সদস্যদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের কোনো ভূমিকা থাকেনা। তাই , গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হলে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাই কাম্য। 

২. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব :- 
আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে - আইন প্রণয়ন , আইন পরিবর্তন , সিদ্ধান্ত গ্রহণ - ইত্যাদি কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে করা যায়। কেননা , দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের মধ্যে মতবিরোধ তৈরী হলে সিদ্ধান্তগ্রহনের ক্ষেত্রে অযথা বিলম্ব হয়। 

৩. জরুরি অবস্থার পক্ষে উপযুক্ত :- 
আপৎকালীন সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় যেহেতু দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় , তাই জরুরি অবস্থার সময় এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অনেক বেশি কার্যকর। 

৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত :- 
হ্যারল্ড ল্যাস্কি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকেই উপযুক্ত বলে দাবী করেছেন। তাঁর মতে , প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টিত হয় সংবিধান দ্বারা। তাই , প্রাদেশিক সরকারগুলির স্বার্থ রক্ষার জন্য উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন। 


৫. ব্যায়ভার কম :- 
দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার তুলনায় এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যায়ভার অনেকটা কম। আইনসভায় দুটি কক্ষ থাকলে বহুসংখ্যক সদস্যদের জন্য আর্থিক ব্যয় প্রচুর হয়। কিন্তু এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সেই ব্যায়ভার অনেকটা কমিয়ে ফেলা যায় এবং সেই অর্থ জাতীয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কার্যে ব্যয় করা যেতে পারে। 

৬. উচ্চ কক্ষের অস্তিত্ব অর্থহীন :- 
দ্বি - কক্ষ আইনসভাগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উচ্চ কক্ষে শাসক দলের প্রতিনিধিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকেন। ফলে তাঁরা সরকারের নীতি , সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির নির্দ্বিধায় সহমত পোষণ করেন। আবার , সমক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ কক্ষগুলিতে বিরোধীদের প্রবল বিরোধিতায় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

৭. সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার সঙ্গে উচ্চ কক্ষের ভূমিকা সম্পর্কহীন :- 
কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে , আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হলে উচ্চ কক্ষ সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এরূপ ধারণার কোনো যৌক্তিকতা নেই ;কেননা , সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয় সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা , সরকারের সদিচ্ছা - ইত্যাদির ভিত্তিতে। এর সঙ্গে আইনসভা দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। 

৮. জনমতের ইচ্ছার প্রকৃত প্রকাশ :- 
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন এবং সরাসরি জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। সরকারি নীতি , সিদ্ধান্ত - ইত্যাদি জনমতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার সকল সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করতে পারেন না এবং জনমতের চাপে জনকল্যাণকারী প্রশাসন পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণ করতে বাধ্য হন। 

এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি :- 


এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল - 

১. স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা :- 
আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে আইনসভার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু আইনসভাতে শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে , তাই শাসক দল নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে যেকোনো ধরণের আইন প্রণয়ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় থাকে না। 

২. সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন সম্ভব নয় :- 
আইনসভার উচ্চ কক্ষ হল জ্ঞানীগুণী মানুষদের সমাবেশ। তাই যেকোনো ধরণের আইন প্রণয়ন করার সময় উচ্চ কক্ষের বিশেষজ্ঞরা সেই সকল প্রস্তাবিত আইন গুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন ও প্রয়োজনে তার পরিবর্তন  করতে পারেন। কিন্তু আইনসভা এককক্ষ হলে তা সম্ভব হয়না। 


৩. সদস্যদের যোগ্যতা সংক্রান্ত বিষয় :- 
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্যরা জনগণ  কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত হন। তাঁরা দক্ষ রাজনীতিবিদ হলেও আইন প্রণয়নের যে সকল যোগ্যতা ও দক্ষতা দরকার হয় , অনেক সময় তা জনপ্রতিনিধিদের থাকেনা। ফলে তাঁদের তৈরী আইন কতটা জনকল্যাণের কাজে আসবে - তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। 

৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত নয় :- 
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয় ও প্রাদেশিক স্বার্থ সুরক্ষিত হয় দ্বি - কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা দ্বারা। কিন্তু আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হলে প্রাদেশিক স্বার্থগুলি উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা উপযুক্ত নয়। 

৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পক্ষে উপযুক্ত নয় :- 
আইনসভাতে যদি সংখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি থাকে তাহলে তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি আইনসভাতে পাঠাতে ব্যর্থ হয় তাহলে তা সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে বিঘ্নিত করে। তাই এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পক্ষে উপযুক্ত নয়। 

৬. রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার সম্ভব নয় :- 
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাতে যেহেতু শুধুমাত্র শাসক দলের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় , তাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক - বিতর্ক , আলোচনা - ইত্যাদির কোনো অবকাশ থাকেনা। ফলে যেকোনো ধরণের আইন , সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ মাধ্যম ও জনসাধারণের কোনো আগ্রহ থাকেনা। ফলে জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেনা। 

৭. উৎকর্ষতা বিষয়ক প্রশ্ন :- 
এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাতে শুধুমাত্র জনগণ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সদস্যপদ লাভ করেন। কিন্তু সেই সকল জনপ্রতিনিধিরা অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক , সামাজিক পরিবর্তন , শিক্ষা , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি - ইত্যাদি বিষয়ে কতটা দক্ষ - সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। উচ্চকক্ষের জ্ঞানীগুণী মানুষদের অভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে উৎকর্ষহীন করে তোলে। 

৮. আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত নয় :- 
আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের পরিবর্তে জনকল্যাণের কাজেই বেশি আগ্রহী। সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তার , নারী ও শিশু কল্যাণ , গ্রাম ও শহর উন্নয়ন , কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মপরিধির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই আইনসভার শুধুমাত্র একটি কক্ষের পক্ষে এইসকল বহুমুখী কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। 

৯. বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত নয় :- 
একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে সর্বদা জাতি , ভাষা , সংস্কৃতি , উন্নয়ন - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকে। তাই এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে সেই বিপুল ভিন্নতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে আঞ্চলিক স্বার্থগুলিও ভিন্ন ভিন্ন হয় - যা এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে সফলভাবে পূর্ণ করা সম্ভব হয়না। তবে , এক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ব্যাতিক্রম। একটি বিপুল জনসংখ্যা যুক্ত রাষ্ট্র হয়েও চীনের আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট। 

পরিশেষে বলা যায় , একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে বাদ দিলে পৃথিবীর শতাধিক রাষ্ট্রের আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট ; তবে সেগুলি আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে যথেষ্ট ক্ষুদ্র।   

You May Also Like

0 comments