সুলতানি যুগের স্থাপত্যরীতির পরিচয় দাও।

by - July 08, 2022

সুলতানি যুগের স্থাপত্যরীতির পরিচয় দাও। 

সুলতানি যুগের স্থাপত্যগত উদ্ভাবন সম্পর্কে আলোচনা কর। 

সুলতানি যুগের স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট। 




সুলতানি যুগের স্থাপত্যকীর্তি : - 


সুলতানি যুগের স্থাপত্যরীতির প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। অধ্যাপক হ্যাভেল মনে করেন , সুলতানি যুগের স্থাপত্যে হিন্দুরীতি প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে ফার্গুসন মনে করেন সুলতানি শিল্পরীতিতে হিন্দু - প্রভাব ছিল নেতিবাচক। আবার মার্শাল , ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রমুখ মনে করেন ইসলামীয় শিল্পরীতিতে কখনো বৌদ্ধ , কখনো জৈন শিল্পরীতি প্রাধান্য পেয়েছে। ইন্দো ইসলামীয় শিল্পরীতিতে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায় - দাস ও খলজিদের আমল ছিল প্রথম পর্যায় , তুঘলক আমলের শিল্পকীর্তিগুলি ছিল দ্বিতীয় পর্যায় এবং প্রাদেশিক ও স্বাধীন রাজ্যগুলিতে বিকশিত শিল্পকর্ম ছিল তৃতীয় পর্যায়। অধ্যাপক দেশাই বলেছেন - দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা একীভূত হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব। 

কুতুবউদ্দিন আইবকের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লির কুয়াত - উল - ইসলাম মসজিদ এবং আড়াই -দিন -কা - ঝোপড়া প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তরাইনের যুদ্ধ জয়কে স্মরণীয় করে রাখতে একটি জৈন মন্দিরকে ভেঙে কুয়াত - উল - ইসলাম তৈরী করেন। আজমিরে একটি সংস্কৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে মাত্র আড়াই দিনে আড়াই - দিন - কা - ঝোপড়া নির্মিত হয়।     
এছাড়া , কুতুবউদ্দিন আইবক বিখ্যাত সুফি সন্ত বখতিয়ার কাকীর স্মৃতিরক্ষার্থে কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য শুরু করেন। ফার্গুসন এই স্তম্ভটিকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও নিখুঁত স্তম্ভ বলে বর্ণনা করেছেন। 

ইলতুৎমিশের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :-

ইলতুৎমিশ কুয়াত - উল - ইসলাম মসজিদ এবং আড়াই -দিন -কা - ঝোপড়া প্রাসাদের সংস্কারসাধন করেন ও স্থাপত্যক্ষেত্রে অতিরিক্ত সংযোজন করেন। কুতুবউদ্দিন আইবক কুতুব মিনারের নির্মাণকার্য শুরু করেছিলেন , সেই নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করেন ইলতুৎমিশ। এছাড়াও ইলতুৎমিশের আমলের অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তিগুলি হল - নিজস্ব সমাধি ভবন , জাম - ই - মসজিদ , হাউস - ই - শামসি - ইত্যাদি। এছাড়াও রায় পিথুরার দক্ষিণে গম্বুজ শোভিত একটি অট্টালিকা নির্মিত হয়। 


বলবনের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণে ব্যস্ত থাকায় বলবন শিল্প ও স্থাপত্যকার্যে অধিক মনোনিবেশ করতে পারেন নি। তবুও তিনি কয়েকটি স্থাপত্য নির্মাণ করেন। তিনি বেলে পাথর নির্মিত একটি লাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। নিজ সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন - যা ইসলামীয় স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। 

আলাউদ্দিন খলজির আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সুদৃঢ়করণের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য নির্মাতা হিসাবেও আলাউদ্দিন খলজি প্রসিদ্ধ। তিনি গম্বুজ সমৃদ্ধ ও খিলান সমৃদ্ধ আলাই দরওয়াজা নির্মাণ করেন। সিরিতে তিনি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং সেখানে হাজার স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এছাড়াও তিনি সন্ত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে জামাইদ - খানা নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সিরিতে তিনি যে প্রাসাদ নির্মাণ করেন তার পাশে সত্তর একর জায়গা জুড়ে এক বৃহৎ পুস্করিণী খনন করেন। এই পুস্করিণী ' হাউজ - ই - খাসবা ' নামে পরিচিত। আলাই দরওয়াজা ছিল আলাউদ্দিন খলজির আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি।     

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে তুঘলকাবাদ নগরীর পত্তন করেন। তাঁর আমলে স্থাপত্য শিল্পের সরলতা ও ব্যবহারযোগ্যতা অধিক প্রাধান্য পায়। যমুনা নদীর স্রোতকে স্থাপত্যনির্মাণের মাধ্যমে তুঘলকাবাদ শহরের জলের প্রয়োজন মেটানো হয়। এছাড়াও গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নিজ সমাধি তৈরী করেছিলেন - যা লাল বেলে পাথরে নির্মিত ছিল। 


মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

মহম্মদ বিন তুঘলক দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করে বহু প্রাসাদ , দুর্গ , উপনগরী ও উপাসনাগার নির্মাণ করেন। তিনি তুঘলকাবাদ শহরে আদিলাবাদ নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এছাড়াও তিনি জাহানপনা - নামে একটি নগরীর পত্তন করেন। 

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

ফিরোজ শাহ তুঘলক অসংখ্য নগর , প্রাসাদ ও বাগিচা নির্মাণ করেন। তিনি দিল্লির পঞ্চম নগরী ফিরোজাবাদ নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলি হল   ফতেহাবাদ , হিসারফিরোজ , জৌনপুর , কোটলা - ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি প্রচুর দুর্গ , সরাইখানা , মসজিদ , প্রাসাদ , জলাশয় ও সেতু নির্মাণ করেন। 

সৈয়দ ও লোদী আমলের স্থাপত্যকীর্তি :- 

তুঘলক বংশের পরবর্তীকালে তৈমুর লং এর ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির স্থাপত্যকর্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়। অসংখ্য স্থাপত্যকীর্তি ধুলিস্মাৎ করে দেওয়া হয়। তাই সৈয়দ ও লোদী শাসকেরা স্থাপত্যের গৌরব ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। খিজির খাঁ দিল্লির উপকণ্ঠে খিজিরাবাদ ও মুবারক শাহ মুবারাকাবাদ শহর গড়ে তোলেন। তবে লোদী আমলে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। লোদী শাসকেরা স্থাপত্য ক্ষেত্রে গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হন। এই সময়কালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তিটি হল সিকন্দর শাহের সমাধি। 

সুলতানি আমলে প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্থাপত্যকীর্তি :- 

সুলতানি যুগে স্থানীয় স্থাপত্য প্রাধান্য লাভ করে। বাংলাদেশ , জৌনপুর , গুজরাট ,মালব এবং দক্ষিণে বাহমনি বিজয়নগর অভিনব স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষর বহন করে। পাথরের অভাবে এইসময় ইঁটের ব্যবহার শুরু হয়। চারকোনা স্তম্ভের উপর আটচালা ছাদ ও তির্যক খিলান সহ মসজিদ ও অট্টালিকা গড়ে ওঠে। এই সময়কালের প্রাচীনতম স্থাপত্যের নিদর্শন হল - হুগলি জেলার ত্রিবেণী মসজিদ , পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ , একলাখি মসজিদ , গৌড়ের দাখিলি দরওয়াজা , কদমরসুল , বড় সোনা মসজিদ , ছোট সোনা মসজিদ - ইত্যাদি। 
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হল - জৌনপুরের অতলা মসজিদ , গুজরাটের জাম - ই - মসজিদ , মালবের হিন্দোলা মহল , রূপমতী মহল , জাহাজ মহল , দাক্ষিণাত্যের গোল গম্বুজ - ইত্যাদি। উক্ত স্থাপত্যকীর্তিগুলির মধ্যে আদিনা মসজিদ ছিল ভারতের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। 

সুলতানি যুগে হিন্দু স্থাপত্যকীর্তি :- 

সুলতানি যুগে ইসলামীয় স্থাপত্যরীতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও হিন্দু স্থাপত্যচর্চা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সুলতানি আমলে হিন্দু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু স্থাপত্য বিকাশ লাভ করে। এই সময়কালে এমন কিছু হিন্দু শৈলীর স্থাপত্য নির্মিত হয় যা আজও শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। যেমন - বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক নির্মিত ভিটলস্বামীর মন্দির , পুরীর জগন্নাথ মন্দির , কোনারকের সূর্য মন্দির - ইত্যাদি। এই মন্দিরগুলির স্থাপত্যরীতি , মন্ডপ , গোপুরম - ইত্যাদি স্থাপত্য নির্মাণে হিন্দু শৈলীকে সমৃদ্ধ করে তোলে।  

  

You May Also Like

0 comments