রাজিয়ার কৃতিত্ব আলোচনা কর। সুলতান রাজিয়া ( ১২৩৬ - ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ ) :-

by - July 08, 2022

রাজিয়ার কৃতিত্ব আলোচনা কর। 



রাজিয়ার কৃতিত্ব : সুলতান রাজিয়া ( ১২৩৬ - ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ ) :- 


ভারতের সুলতানি শাসনের ইতিহাসে রাজিয়ার সিংহাসনারোহন নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে '' সুলতানা রাজিয়া '' প্রত্যয়টি সঠিক নয়। কেননা সুলতানা শব্দের অর্থ সুলতানের স্ত্রী ; কিন্তু রাজিয়া কোনো সুলতানের স্ত্রী ছিলেন না। ইলতুৎমিশের মনোনীত সার্থক উত্তরাধিকারী হিসাবে , নিজ ক্ষমতা ও প্রতিভাবলে তিনি সিংহাসন অর্জন করেন ও শাসন কার্য পরিচালনা করেন। রাজিয়া নিজেও নিজ মুদ্রায় নিজেকে '' সুলতান '' বলেই অভিহিত করেছেন। এছাড়া ঐতিহাসিক মিনহাজ সিরাজও তাঁকে ' সুলতান ' বলে অভিহিত করেছেন। 


রাজিয়ার সিংহাসনলাভ :- 
পিতা ইলতুৎমিশ রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করছিলেন। রাজিয়ার বুদ্ধিমত্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে ইলতুৎমিশ রাজিয়ার নামাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেন। কিন্তু ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর নারীর শাসন ইসলামের নীতি বিরুদ্ধ বলে মনে করে তাঁরা ইলতুৎমিশের অপদার্থ পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু বিলাসপ্রিয় ও অকর্মন্য রুকনউদ্দিন শাসন কার্যের সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিলেন। এর ফলে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তার মাতা শাহ তার্কানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। শাহ তার্কান ছিলেন নিম্নবংশীয় ও উচ্চাভিলাসিনী। দরবারে তাঁর অগণিত অনুচরবর্গের সাহায্যে তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র অকথ্য অত্যাচার শুরু করেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। 

এরপর মুলতান , লাহোর , হান্সি , বদাউন - ইত্যাদি প্রদেশের শাসনকর্তারা শাহ তার্কানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। রাজিয়া এই পরিস্থিতির সুযোগে সেই বিদ্রোহী শাসনকর্তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। বহু সামরিক কর্মচারী ও রাজকর্মচারীরাও রাজিয়াকে সমর্থন করতে থাকেন। অবশেষে দিল্লির আমির - ওমরাহরা রুকনুদ্দিনকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজিয়াকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। 

রাজিয়ার সিংহাসনলাভের বৈশিষ্ট ও গুরুত্ব :- 
রাজিয়ার সিংহাসনলাভ একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন - 
(i) রাজিয়ার সিংহাসনলাভ ছিল দিল্লি সুলতানির ইতিহাসে সর্বপ্রথম নাগরিকদের সমর্থন দ্বারা সিংহাসনলাভ। রাজিয়ার ক্ষমতার উৎস ছিল নাগরিকদের সমর্থন। 
(ii) রাজিয়া দিল্লির নাগরিকদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। রাজিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে তিনি দিল্লির নাগরিকদের আশা - আকাঙ্খা পূরণ করতে না পারলে সিংহাসন ত্যাগ করবেন। 
(iii) ইলতুৎমিশ কর্তৃক রাজিয়ার মনোনয়ন যে যুক্তিযুক্ত ছিল - তা প্রমাণিত হয়। 
(iv) সিংহাসনের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উলেমাদের গুরুত্ব হ্রাস পায়। 
(v) সুলতানি শাসনের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসাবে রাজিয়া সাফল্যের সঙ্গে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। 


রাজিয়ার প্রাথমিক সমস্যা :- 
রাজিয়ার সিংহাসনলাভ নিষ্কণ্টক ছিল না। সিংহাসনলাভ করেই তাঁকে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন - 
(i) রাজিয়া পুরুষের পোশাক পরিধান করে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এই বিষয়টি গোঁড়া মুসলমানদের অসহিষ্ণু করে তুলেছিল। 
(ii) ইয়াকত নামে এক হাবসী অনুচরের প্রতি অতিরিক্ত অনুগ্রহ তুর্কি আমির ওমরাহদের বিরক্তি ও ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল। 
(iii) রাজিয়া বিরোধী চল্লিশ চক্রের নেতা মালিক মহম্মদ জুনাইদি রাজিয়ার সিংহাসনলাভের বিরোধিতা করতে থাকেন। 
(iv) রুকনুদ্দিনকে সিংহাসন থেকে পদচ্যুত করতে সাহায্য করলেও মুলতান , হান্সি , লাহোর , বদাউন - ইত্যাদি বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তারা রাজিয়ার সিংহাসনলাভের বিরোধিতা করতে থাকেন। 
(v) লাহোর , মুলতান , হান্সি ও বদাউন প্রদেশের শাসনকর্তারা দিল্লি অবরোধ করেন। 

রাজিয়ার রাজনৈতিক কৌশল :- 
ইতিপূর্বেই ইলতুৎমিশ রাজিয়ার রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় পেয়েছিলেন। সিংহাসনারোহন করেই রাজিয়া বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হলেও তাঁর প্রবল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা তাঁর সিংহাসনকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথমেই তিনি বিদ্রোহী আমির ওমরাহদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন ও বিরোধী আমিরদের নিজপক্ষে আনতে সমর্থ হন। কবির খান , মহম্মদ সালারি - প্রমুখ বিদ্রোহী নেতাকে রাজিয়া নিজপক্ষে নিয়ে আসেন। রাজিয়া বিরোধী চল্লিশ চক্রের প্রধান নেতা মহম্মদ জুনাইদিকে রাজিয়াকে হত্যা করেন। এইভাবে রাজিয়া রাজনৈতিক সুকৌশলে নিজের সিংহাসনকে সুরক্ষিত করেন। 

প্রাদেশিক নেতাদের বিদ্রোহ দমন :- 
রাজিয়া অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ দমন করেন। ইতিপূর্বেই তিনি চল্লিশ চক্রের প্রধান বিদ্রোহী নেতা মহম্মদ জুনাইদিকে হত্যা করেছিলেন। লাহোরের শাসনকর্তা কবির খাঁনের বিদ্রোহ তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ সিরাজ বলেছেন , বাংলা থেকে সিন্ধু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তারা রাজিয়ার কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। 


চল্লিশ চক্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ : -
ইলতুৎমিশের রাজত্বকাল পর্যন্ত সুলতান স্বয়ং চল্লিশ চক্র বা ' বন্দেগান - ই - চাহেলগান ' - এর সন্তুষ্টি বিধানে সচেষ্ট থাকতেন। কিন্তু রাজিয়ার আমলে প্রথম এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রাজিয়া সর্বপ্রথম চল্লিশ চক্রের সকল ক্ষমতা খর্ব করে নিজের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি চল্লিশ চক্রকে একপ্রকার বিলুপ্ত করেন। 

নিজ অনুগত গোষ্ঠী গঠন :- 
রাজিয়া প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে অতুর্কি মুসলমানদের উচ্চপদে নিয়োগ করে অভিজাত মুসলমানদের ক্ষমতা ধ্বংস করেন। শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজিয়া অতুর্কি মুসলমানদের নিয়ে নিজ অনুগত একটি গোষ্ঠী তৈরী করেন। জামালউদ্দিন ইয়াকত নামে এক অতুর্কি হাবশি অনুচরকে তিনি প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। সমস্ত রাজকর্মচারীরা যারা সুলতানি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক ছিল , তাদের রাজিয়া নিছক কর্মচারীতে পরিণত করেন। 

রাজিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র :- 
তুর্কি আমিররা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র রচনা করেন। অভিজাত নেতা বলবন ও রাজকর্মচারী আইতেগিনের সহায়তায় পাঞ্জাবের ভাটিন্ডার শাসনকর্তা আলতুনিয়া রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজিয়া তাঁর প্রধান সেনাপতি জামালউদ্দিন ইয়াকত খাঁকে সঙ্গে নিয়ে আলতুনিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু যুদ্ধে ইয়াকত নিহত হন ও রাজিয়া আলতুনিয়ার হাতে বন্দিনী হন। 

রাজিয়ার অন্তিম পরিণতি :- 
আলতুনিয়ার হাতে রাজিয়া বন্দিনী হলে রাজিয়ার ভাই বাহরাম শাহ সিংহাসনলাভ করেন ও আমির ওমরাহরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন উচ্চপদ ভাগ করে নেন। কিন্তু আলতুনিয়া কোনো উচ্চপদ লাভ না করায় আলতুনিয়া রাজিয়াকে বিবাহ করেন ও সম্মিলিতভাবে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। তবে তাঁদের নিজেদের সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং সুলতানি বাহিনীর হাতে আলতুনিয়া ও রাজিয়া উভয়ের মৃত্যু হয়। 

রাজিয়ার কৃতিত্ব :- 
ঐতিহাসিক নিজামি বলেছেন - ইলতুৎমিশের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রাজিয়া ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ফেরিস্তা বলেছেন - কূটনৈতিক বুদ্ধিতে রাজিয়া অসাধারণ ছিলেন। মিনহাজ সিরাজ রাজিয়াকে শ্রেষ্ঠ শাসক , সমরকুশলী , ন্যায়পরায়ণ , দয়াশীল বলে উল্লেখ করেছেন। 
রাজিয়ার কৃতিত্বের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় রাজিয়া প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। চল্লিশ চক্রকে দমন করে , প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ দমন করে - একজন একজন নারী হিসাবে রাজিয়া ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছেন। সমগ্র অভিজাত সমাজ , তুর্কি মুসলমান ও চল্লিশ চক্রের বিরুদ্ধে রাজিয়া একাকী যে সাহসিকতা ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই কৃতিত্বের দাবী রাখে।



You May Also Like

1 comments