দিল্লি সুলতানির পতনের কারণ।

by - July 09, 2022

দিল্লি সুলতানির পতনের কারণ। 

দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর। 

দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী বিষয়গুলি উল্লেখ কর। 




দিল্লি সুলতানি পতনের কারণ :-  


দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। রাজতন্ত্রের প্রকৃতি ও প্রশাসনিক নীতির মধ্যেই দিল্লি সুলতানির পতনের কারণগুলি নিহিত ছিল। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরী ভারত ত্যাগ করেন ও তাঁর বিজিত অঞ্চলগুলির দায়িত্ব দিয়ে যান কুতুবউদ্দিন আইবকের হাতে। কুতুবউদ্দিন আইবকের হাত ধরে দিল্লিতে দাস বংশের সূচনা হয়। এরপর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে মোগল ভাগ্যান্মেসি বাবরের হাতে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত হন। ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে দিল্লি সুলতানির পতন ঘটে এবং মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। নীচে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করা হল। 


১. মহম্মদ বিন তুঘলকের দায়িত্ব :- 
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার চরম শিখরে ওঠে। কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষের দিক থেকেই সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। মহম্মদ বিন তুঘলকের ব্যক্তিগত চরিত্র ও প্রশাসনিক নীতি , অবাস্তব পরিকল্পনা - ইত্যাদি বিষয়গুলি সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট করেছিল। উপরন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের এই সকল পরিকল্পনাগুলির ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিল এবং রাজকোষের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। 

২. ফিরোজ তুঘলকের দায়িত্ব :- 
ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ধর্মান্ধতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা দুর্নীতিপরায়ণ মালিক , আমির - ওমরাহদের হস্তগত হয়। দুর্নীতিপরায়ণ ও লোভী উলামারা রাষ্ট্রের ব্যাপারে আধিপত্য বিস্তার করে। সুলতান উলেমাদের ক্রীড়নকে পরিণত হন। কোরানের নির্দেশ অনুসারে শাসন কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি উলেমাদের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এছাড়াও ফিরোজের ঔদাসীন্যের ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রশাসনিক , রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। 


৩. পরবর্তী সুলতানদের অযোগ্যতা :- 
সুলতানি সাম্রাজ্যের ভিত্তি নির্ভরশীল ছিল সুলতানদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর। আলাউদ্দিন খলজির পরবর্তী সময়কাল থেকেই সুলতানদের ঔদাসীন্য , দুর্বলতা , বিলাসপ্রিয়তা , নীতিহীনতা - ইত্যাদি বিষয়গুলি সুলতানি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল। শাসনকার্যের ব্যাপারে আমির - ওমরাহ ও উলেমাদের মাত্রারিক্ত প্রভাবের ফলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়। 

৪. সাম্রাজ্যের বিশালতা :- 
আলাউদ্দিন খলজি দক্ষিণ ভারত জয় করেও তা সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি ; শুধুমাত্র কর আদায় করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলক দক্ষিণ ভারতকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করলে একদিকে সাম্রাজ্যের আয়তন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় ও অন্যদিকে প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈষম্য সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট করে। সাম্রাজ্যের প্রসারণের নীতি গ্রহণ করলেও তার সংহতিসাধনে আলাউদ্দিনের পরবর্তী সুলতানগণ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। 

৫. অভিজাতদের নৈতিক অবনতি :- 
অভিজাতশ্রেণী ছিল দিল্লি সুলতানির স্তম্ভ। সাম্রাজ্যের প্রসারণে ও উন্নতিবিধানে এবং সংহতিসাধনে অভিজাতদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আলাউদ্দিন খলজির পরবর্তী সময়কালে অভিজাতদের নৈতিক অবনমন ঘটে। দুর্নীতি , বিলাসব্যাসন , ষড়যন্ত্র - ইত্যাদিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে প্রশাসন দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিন খলজির পরবর্তীকালের সুলতানগণ অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তা সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

৬. ক্রীতদাস প্রথার কুফল :- 
সুলতানি শাসনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ক্রীতদাসপ্রথা সুলতানি সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করেছিল ঠিকই ; কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ক্রীতদাস সম্পর্কে সুলতানের নীতি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। ক্রীতদাসদের অনিয়ন্ত্রিত অধিকার , সংখ্যাধিক্য - ইত্যাদি বিষয়গুলি সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে দেয়। আলাউদ্দিনের পরবর্তী সময়ের সুলতানগণ ক্রীতদাসদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। ক্রীতদাসরা অধিক ক্ষমতা লাভ করার ফলে তাদের কায়েমী স্বার্থ সুলতানি সাম্রাজ্যের পক্ষে নেতিবাচক ফল প্রদান করেছিল। 


৭. হিন্দুদের বিরোধিতা :- 
সুলতানি শাসকদের মধ্যে প্রায় কেউই হিন্দুদের জন্য উদারপন্থী নীতি গ্রহণ করেন নি। সুলতানি শাসকেরা স্থায়ীভাবে উত্তর ভারতের হিন্দু প্রজা ও শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন নি। এমনকি দক্ষিণ ভারতেও হিন্দুরা কখনওই সুলতানি শাসনকে মেনে নেন নি। সুলতানি শাসকেরা হিন্দু বিদ্বেষের নীতি গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। সুলতানি আমলে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয় , ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া নির্বিচারে চলতে থাকে। সুলতানি শাসকদের এই ধরণের হিন্দু নীতির ফলে সুলতানি শাসকেরা কখনই হিন্দুদের সমর্থনলাভ করতে পারেন নি। 

৮. জনসমর্থনের অভাব :- 
দিল্লি সুলতানির মূল ভিত্তি ছিল সামরিক শক্তি। মোগল সম্রাটেরা , বিশেষ করে আকবর , যেভাবে হিন্দু - মুসলিম নির্বিশেষে সকলের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেছিলেন - সুলতানি শাসকেরা সেইরূপ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। তাই জনসমর্থন নীতিকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র সামরিক শক্তি ও বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর করে কোনো সাম্রাজ্যের পক্ষেই দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রতি আপামর জনসাধারণের কোনো সমর্থন বা আনুগত্য ছিল না। 

৯. সেনাবাহিনীর দুর্বলতা :- 
আলাউদ্দিন খলজি তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রয়োজনে এবং বিশাল সাম্রাজ্যের সংহতিসাধনে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে পরিস্থিতি বদলে যায়।ফিরোজ তুঘলক সেনাবাহিনীতে বংশানুক্রমিক সেনা নিয়োগের নীতি গ্রহণ করলে সেনাবাহিনী অলস , কর্মবিমুখ ও অকর্মন্য হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিন খলজি সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে কঠোর , বাস্তবোচিত ও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকগণ সেনাবাহিনী সম্পর্কে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে ও সেনাবাহিনিকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হন। ফলে আলাউদ্দিনের পরবর্তী সময় থেকেই সুলতানি সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। 

১০. সংহতি বিরোধী শক্তিগুলির সাফল্য :- 
দিল্লি সুলতানি শাসনের ক্ষেত্রে অভিজাত , আমির - ওমরাহ ও উলামারা ছিল একই সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভুমিকাসম্পন্ন। তাঁরা একদিকে যেমন সুলতানি সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন , অন্যদিকে তেমনই শাসকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করতে গেলে তা সুলতানি সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বলবন , আলাউদ্দিন খলজি - প্রমুখ সুলতানগণ কঠোর হাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তাঁদের সাম্রাজ্যের উন্নতিকল্পে ব্যবহার করেন ; কিন্তু পরবর্তীকালের সুলতানগণ নিজেদের দুর্বলতার ফলে ওই সকল শক্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। এইসকল সংহতি বিরোধী শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করায় সাফল্যলাভ করতে থাকলে তা প্রশাসনকে দুর্বল করে তোলে। 

১১. তৈমুরের আক্রমণ : - 
সুলতানি সাম্রাজ্যে বারংবার মোঙ্গল আক্রমণ সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। একমাত্র বলবন ও আলাউদ্দিন খলজি মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার পরবর্তী সুলতানগণ যথার্থ মোঙ্গল বিরোধী নীতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। এরপর তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের চরম ক্ষতিসাধন করে। সীমাহীন লুঠ - তরাজ ও ধ্বংসলীলা সুলতানি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। 

১২. বাবরের আক্রমণ ও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ( ১৫২৬ ) :- 
উপরোক্ত কারণগুলির জন্য দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য যখন পতনের দোরগোঁড়ায় পৌঁছেছিল তখন ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবরের আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনকে সম্পূর্ণ করে। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সুলতানি সেনাবাহিনী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে বাবরের ক্ষুদ্র গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে ইব্রাহিমের বিশাল সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে।   


You May Also Like

0 comments