ইকতা ব্যবস্থার পরিচয় , বৈশিষ্ট , বিবর্তন ও রাজনৈতিক গুরুত্ব । ইকতা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।

by - July 11, 2022

ইকতা ব্যবস্থার পরিচয় , বৈশিষ্ট , বিবর্তন ও রাজনৈতিক গুরুত্ব । 

ইকতা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।  




ইকতা ব্যবস্থার পরিচয় : - 

ইকতা শব্দের অর্থ হল একটি অংশ বা একটি এলাকা। ডক্টর ইরফান হাবিবের মতে , কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্তের এক অংশ কর হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং তা প্রাদেশিক শাসকদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এইভাবে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে তা প্রাদেশিক শাসকদের মধ্যে বন্টন করার যে পদ্ধতি তা ইকতা - নামে পরিচিত ছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে তৎকালীন প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করা। 

সুলতানি আমলে দুই ধরণের জমির অস্তিত্ব ছিল। সুলতানের খাস জমি বা খালিসা - এই ধরণের জমির রাজস্ব আদায় করতেন সরকারি কর্মচারীরা। জমির দ্বিতীয় ধরণ ছিল - ইকতা। এই ব্যবস্থায় সুলতান নির্দিষ্ট শর্তে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করতেন। যারা জমি পেতেন তাদের বলা হত ইকতাদার। 


ভারতে ইকতা প্রথার প্রচলন :- 

ভারতে ইকতা ব্যবস্থা প্রচলন করেন ইলতুৎমিশ। যদিও এই ব্যবস্থা তুর্কি জগতে আগেই প্রচলিত হয়েছিল। কুতুবউদ্দিন আইবকের পর ইলতুৎমিশের আমলেও ভারতে নির্দিষ্ট কোনো রাজস্ব নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সেনাদের নগদে বেতন দেওয়ার মত প্রাচুর্য রাজকোষের ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ইলতুৎমিশ তুর্কি শাসকদের বহু পরীক্ষিত ইকতা ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করেন। 

ইকতা বন্দোবস্তের প্রকৃতি :- 

ইকতা প্রথা শুধুমাত্র খালিসা জমি বহির্ভুত জমিগুলির মধ্যেই প্রচলিত ছিল। খালিসা জমিগুলি থেকে রাষ্ট্র সরাসরি রাজস্ব আদায় করত। যারা ইকতা বন্দোবস্ত লাভ করতেন তাদের বলা হত ইকতাদার বা মাকতি। ইকতাদার নির্দিষ্ট শর্তে ইকতা লাভ করতেন। যেমন - 
(i) প্রয়োজনের সময় ইকতাদার সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতেন। 
(ii) নিজের এলাকায় ইকতাদার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। 
(iii) নিজের ইকতা এলাকায় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব ইকতাদার বহন করতেন। 


ইকতা বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট :- 

ইকতা বন্দোবস্তের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি ছিল - 
(i) শুধুমাত্র কৃষকদের উদ্বৃত্ত থেকেই রাজস্ব আদায় করা হত। 
(ii) ইকতাদার কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারলেও কৃষকের উপর বা তার জমির উপর ইকতাদারদের কোনো অধিকার ছিল না। জমির অধিকার ছিল একমাত্র সুলতানের। 
(iii) রাজস্বের পরিমাণ ইকতাদার নির্ধারণ করতে পারতেন না। রাজস্ব নির্ধারণ করত রাষ্ট্র। 
(iv) কৃষক ইচ্ছা করলে ইকতাদারের বিরুদ্ধে সুলতানের কাছে অভিযোগ জানাতে পারতেন এবং এ বিষয়ে কৃষককে বাধা দেওয়ার অধিকার ইকতাদারের ছিল না। 
(v) ইকতার বিনিময়ে প্রতিটি ইকতাদার নিজস্ব ইকতা এলাকায় প্রশাসন পরিচালনা ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করত। 
(vi) প্রতিটি ইকতাদার নিজস্ব এলাকায় সৈন্যবাহিনী পোষণ করতেন। প্রয়োজনের সময় ইকতাদার সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতে বাধ্য ছিলেন। 
(vii) জমির উপর ইকতাদারের কোনো অধিকার ছিলনা। জমির মালিক সম্পূর্ণরূপে ছিলেন সুলতান। 
(viii) ইকতাদারদের স্থায়িত্ব ও অস্তিত্ব নির্ভর করত সুলতানের ইচ্ছার উপর। সুলতানের বিরাগভাজন হলে ইকতাদার পদচ্যুত হতেন। 
(ix) ইকতাদারদের মধ্যে বদলি প্রথাও প্রচলিত ছিল। 
(x) ইকতাদার তার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা করতেন। 

বিভিন্ন সময়ে ইকতা বন্দোবস্তের পরিবর্তন :- 

সুলতান ইলতুৎমিশের সময়কাল থেকেই ইকতা প্রথা প্রচলিত হয় এবং তাঁর আমল থেকেই ইকতা প্রথার বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়। 

ইলতুৎমিশের আমলে ইকতা প্রথার প্রচলন ও পরিবর্তন :- মূলতঃ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্যই ইলতুৎমিশ ভারতে ইকতা প্রথা প্রচলন করেন। তিনি ইকতাদারদের মধ্যে বদলির নীতি প্রচলন করেন। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় স্তরে দৃঢ় কেন্দ্রীভবনের নীতি গ্রহণ করলে ইকতাদাররা সুলতানের সহায়ক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। 

বলবনের আমলে ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- বলবনের আমলে কেন্দ্রীয়করণের নীতি আরো সুদৃঢ় হয়। তিনি কঠোরভাবে হিসাব পরীক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেন এবং এই কাজের জন্য খোয়াজা নামের এক শ্রেণির রাজকর্মচারী নিযুক্ত করেন। তাঁর আমলে ইকতাদারদের নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। বলবনের আমলে ইকতা প্রথা বংশানুক্রমিক ছিলনা। 

আলাউদ্দিন খলজির আমলে ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- আলাউদ্দিন খলজির আমলে সাম্রাজ্যের আয়তন বহুগুনে বৃদ্ধি পায় ফলে জমির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ইকতা প্রথায় বিভিন্ন পরিবর্তন সাধন করেন আলাউদ্দিন। তিনি কেবলমাত্র দিল্লি থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলিতে ইকতা প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন। দিল্লি ও তার নিকটবর্তী এলাকাগুলিকে খালিসা জমিতে পরিণত করে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের নীতি গৃহীত হয়। তিনি প্রতিটি জমির রাজস্বের হার নির্দিষ্ট করে দেন। ইকতাদারদের হিসাব পরীক্ষার ক্ষেত্রে আরো কড়াকড়ি শুরু হয়। শুধুমাত্র সেনাপতিকে ইকতা প্রদান করে সৈন্যদের সরাসরি বেতন দেওয়ার নীতি গৃহীত হয়। 

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- গিয়াসউদ্দিন তুঘলক স্থির করেন যে যদি কোনো ইকতাদার তার প্রাপ্যের ১/১০ বা ১/১১ ভাগ বেশি রাজস্ব আদায় করত তাহলে তা ক্ষমার চোখে দেখা হবে। বলা বাহুল্য গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইকতাদারদের উপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। 

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- মহম্মদ বিন তুঘলক সেনাদের নগদে বেতন প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে রাজস্ব আদায় ও সেনাবাহিনীর পোষণ - এই দুটি বিষয়কে পৃথক করে দেন। ইকতার প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে সেনাপতিদের সরিয়ে দেওয়া হয়। মহম্মদ বিন তুঘলক সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ইকতা প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইকতা ব্যবস্থার পরিবর্তন :- ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইকতাদারদের উপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে হ্রাস পায়। তিনি অভিজাতদের বেতন বৃদ্ধি ঘটান এবং হিসাব পরীক্ষার বিষয়টি অনেক শিথিল হয়ে পড়ে। তাঁর আমলে রাষ্ট্রের মোট আয়ের বা জমার হিসাব তৈরী করা হয়। এই নির্দিষ্ট জমা - র বেশি রাজস্ব ইকতাদারদের প্রদান করতে হত না। তিনি ইকতা প্রথাকে বংশানুক্রমিক করেন এবং প্রচুর ইকতা বিতরণের ফলে খালিসা জমির পরিমাণ কমে গিয়ে রাষ্ট্রের আয় হ্রাস পায়। 

সৈয়দ ও লোদী আমলে ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- সৈয়দ ও লোদী আমলে ইকতা কথাটির পরিবর্তে সরকার ও পরগণা শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি পরগণা নিয়ে একটি সরকার গঠিত হয়। এই সময়কালে ইকতা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেও মূল কাঠামো বজায় থাকে। 


ইকতা ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি :- 

ইকতা বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এর দুর্নীতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হিসাব , উদ্বৃত্ত অর্থ আত্মসাৎ করা - এগুলি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সামন্তপ্রথার ত্রুটিগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে ইকতা প্রথার প্রচলন করা হলেও সামন্ত প্রথার সমস্ত রকম ক্ষতিকর দিকগুলি ইকতা বন্দোবস্তের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। খালিসা জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ইকতা থেকে রাষ্ট্রের আয় কমে যায়। ফিরোজ শাহ তুঘলক ইকতা ব্যবস্থায় বংশানুক্রমিক নীতির প্রচলন করলে ইকতাদারদের উপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। 

ইকতা ব্যবস্থার গুরুত্ব :- 

(ক) তুর্কি শাসনের সূচনালগ্নে প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে ইকতা ব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছিল। 
(খ ) ইকতা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাদেশিক রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা সম্ভব হয়েছিল। 
(গ) ইকতা প্রদানের মাধ্যমে আমির - ওমরাহদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। 
(ঘ) প্রাথমিক পর্বে সুলতানগণ ইকতা ব্যবস্থার মাধ্যমে সামন্ত প্রথার অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। 
(ঙ ) বদলি নীতির ফলে ইকতাদাররা নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাচার করতে পারতেন না। 
(চ ) যেহেতু জমির মালিক ছিলেন সুলতান - সেহেতু জমির উপর কখনোই ইকতাদারদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 
(ছ ) কৃষক স্বাধীনভাবে ইকতাদার বা মাকতির বিরুদ্ধে সুলতানের নিকট অভিযোগ জানাতে পারতেন। ফলে এই ব্যবস্থায় কৃষকদের স্বার্থ তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত ছিল। 
(জ) দূরবর্তী এলাকাগুলি থেকেও রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়। 
(ঝ ) প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। 
(ঞ ) সামগ্রিকভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে।  


You May Also Like

1 comments