জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পথে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল ?
জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পথে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল ?
জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পথে প্রধান বাধা / অন্তরায় :-
১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টফ্যালিয়ার সন্ধির মাধ্যমে জার্মানিকে প্রায় দুশোটি ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করা হয়। এরপর নেপোলিয়নের সময়কালে তিনি বহুধাবিভক্ত জার্মানিকে ৩৯ প্রদেশে বিভক্ত করেন। কিন্তু এই সময় অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য , মেটারনিকের রক্ষণশীল নীতি - ইত্যাদি কারণে জার্মানির ঐক্য সম্ভব ছিলনা। জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা বা অন্তরায়গুলি ছিল নিম্নরূপ।
১. ভিয়েনা সম্মেলন :-
ভিয়েনা সম্মেলনে নেপোলিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত পূর্বেকার ৩৯ টি প্রদেশেই জার্মানিকে বিভক্ত রাখা হয়। কিন্তু প্রত্যেক জার্মান রাজ্যের স্বতন্ত্রতা বজায় থাকায় জার্মানির সার্বিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। ৩৯ টি জার্মান প্রদেশের স্বতন্ত্রতা বজায় থাকলেও প্রতিটি প্রদেশে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য বজায় থাকে। এছাড়াও , জার্মান প্রদেশগুলির ওপর বুন্ড রাষ্ট্রমন্ডলের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তাই বলা যেতে পারে ভিয়েনা সম্মেলন পরোক্ষভাবে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়।
২. অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য :-
মেটারনিখ ঐক্যবদ্ধ জার্মানিকে অস্ট্রিয়া তথা সমগ্র ইউরোপের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। যেহেতু ভিয়েনা সম্মেলনের পর থেকে সমগ্র ইউরোপে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় , তাই মেটারনিকের দমনমূলক নীতিগুলি ছিল জার্মান ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে অপর একটি অন্তরায়। ঐক্যবদ্ধ জার্মানির আদর্শ মেটারনিকের কাছে ছিল একটি অপবিত্র আদর্শ [ An infamous object ] ।
৩. রাজনৈতিক অগ্রগতির অভাব :-
যেহেতু বহুধাবিভক্ত জার্মান রাজ্যগুলির স্বতন্ত্রতা বজায় ছিল , সেহেতু প্রতিটি জার্মান প্রদেশ মনে করত যে তারা স্বাধীন। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে জার্মানরা রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অর্থনীতি , কৃষি , শিল্প , বাণিজ্য - ইত্যাদি নিয়েই অধিক ব্যাস্ত ছিল। রাজনীতিবিদ ও জার্মান নেতারা জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ভিয়েনা সম্মেলনের সমালোচনায় অধিক উৎসাহী ছিলেন।
৪. আদর্শগত মতভেদ :-
জার্মানির জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব ছিল জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে একটি প্রধান বাধা। কেই কেউ স্টেইন হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্রের অধীনে জার্মান সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ; আবার কেউ কেউ প্রাশিয়ার অধীনে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ গণতান্ত্রিক জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। জার্মান নেতৃবর্গের এইরূপ আদর্শগত মতভেদ সম্পর্কে কার্ল মার্কস বলেছেন - Thus German unity was in itself a question big with disunion and discord. ।
৫. প্রাদেশিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ :-
জার্মান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভাষাগত ও জাতিগত কোনো ভেদাভেদ না থাকলেও তাদের মধ্যে আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতা প্রবলভাবে বজায় ছিল। বিশেষ করে ব্যাভেরিয়া , স্যাক্সনি - ইত্যাদি প্রদেশগুলির প্রবল আঞ্চলিকতাবাদ জার্মান ঐক্যের স্বপ্নকে প্রতিহত করে। তারা অখন্ড জার্মান রাষ্ট্রের তুলনায় নিজেদের স্বতন্ত্রতা বিষয়ে অধিক উৎসাহী ছিল।
৬. ধর্মীয় মতভেদ :-
সমগ্র জার্মান রাষ্ট্রগুলির উত্তরাংশে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ এবং দক্ষিণ অংশে ক্যাথলিক মতবাদ প্রচলিত ছিল। এই দুই মতাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল প্রবল। তাই জার্মানির ঐক্য স্থাপনের পথে অন্তরায় হিসাবে ধর্মীয় মতভেদকে অস্বীকার করা যায়না।
৭. বৈদেশিক প্রভাব :-
অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া জার্মান রাষ্ট্রসংঘের অন্তৰ্ভুক্ত হলেও যেহেতু উভয় প্রদেশে জার্মান ছাড়াও আরো বহু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বজায় ছিল - তাই অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া একটি জার্মান জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের অংশীদার হতে অসম্মত হয়। এছাড়া ফেডারেল ডায়েট - এ অ-জার্মান প্রাধান্য ছিল প্রবল। এছাড়াও জার্মান রাষ্ট্রসংঘের অন্তর্গত হলস্টেইন প্রদেশে ডেনমার্কের প্রভুত্ব বজায় ছিল। এইসকল বৈদেশিক বিষয়গুলি জার্মান ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
৮. ডায়েটের দুর্বলতা :-
জার্মানির বিভিন্ন প্রদেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ডায়েটের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব ছিল না। এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে কোনো সিদ্ধান্তেই ডায়েট একটি সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারত না। ফলে ডায়েটের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মেটারনিখ সমগ্র জার্মান রাষ্ট্র জুড়ে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন।
৯. উদারনৈতিক আন্দোলনগুলির ব্যর্থতা :-
জার্মানিতে কিছু উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হলেও জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেগুলি যথেষ্ট ছিল না। গেটে , শিলার প্রমুখ দার্শনিকগণ জার্মান জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করেন। এছাড়া ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগত প্রভাব জার্মান জাতীয়তাবাদীদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বজায় ছিল। কেউ কেউ রাজতন্ত্রের অধীনেই গণতান্ত্রিক আদর্শগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ; আবার কেউ কেউ সমগ্র জার্মানির রাষ্ট্রীয় ঐক্যের কথা বলেন।
১০. কার্লসবাড ডিক্রি :-
জার্মানিতে ফরাসি বিপ্লব হতে উদ্ভুত সকল প্রকার প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক চিন্তাধারার প্রসার রোধ করতে মেটারনিখ বদ্ধপরিকর ছিলেন। কেননা , মেটারনিখ ভালোভাবেই জানতেন জার্মানিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বিনষ্ট হবে। তাই মেটারনিখ বহু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি প্রবর্তন করেন - যার মধ্যে কার্লসবাড ডিক্রি হল অন্যতম। এই নির্দেশিকার মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদারনৈতিক ভাবধারার কণ্ঠরোধ করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়।
১১. ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্টের ব্যর্থতা :-
জার্মানির ঐক্য সাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৫৮৬ জন জার্মান প্রতিনিধিকে নিয়ে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্ট গঠিত হয়। এর পরের বছর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রাশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিখ উইলিয়ামকে জার্মানির শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ফ্রেডরিখ উইলিয়াম তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রকৃতপক্ষে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্টে জনসাধারণের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়নি। কেননা এতে কৃষক , শ্রমিক - ইত্যাদি শ্রেণীর কোনো প্রতিনিধি ছিল না এবং বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল।
সুতরাং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় প্রকার অন্তরায়গুলি অখন্ড জার্মান রাষ্ট্রের আদর্শকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেছিল। এর ফলে ব্যাহত হয় সর্ব-জার্মানবাদ। তবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় এবং জার্মানির ভাগ্যাকাশে বিসমার্কের উত্থান ঘটে। বিসমার্কের নেতৃত্বে মাত্র তিনটি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ( ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ , অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ) জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।
0 comments