­
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি লেখ। - NANDAN DUTTA

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি লেখ।

by - May 01, 2025

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি লেখ। 




ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি লেখ। 

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ইউরোপীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সন্ধির পর ইউরোপ বড় কোনো যুদ্ধের সাক্ষী থাকেনি। কিন্তু ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে ইউরোপের ৪০ বছরের সেই শান্তির যুগের অবসান ঘটে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইউরোপের প্রায় সকল বৃহৎ শক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করে। আপাত দৃষ্টিতে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ছিল অতি তুচ্ছ। জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র স্থানের অধিকার কার হাতে থাকবে এই নিয়ে গ্রিক ও ল্যাটিন ধর্মযাজকদের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত একটি বৃহৎ যুদ্ধের জন্ম দেয়। তবে , ঐতিহাসিকভাবে একথা প্রমাণিত যে , ক্রিমিয়ার যুদ্ধের মূলে ছিল বেশ কিছু রাজনৈতিক বিষয়। 

১. গ্রোটোর গির্জা সংক্রান্ত বিরোধ :-
তুর্কির সুলতান ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দের এক চুক্তির দ্বারা যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জা ও অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব ক্যাথলিক গির্জাকে প্রদান করেন। ক্যাথলিক ফ্রান্স এই দায়িত্বের রক্ষাকর্তা নিযুক্ত হয়। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্স শক্তিহীন হয়ে পড়লে সেই সুযোগে রাশিয়া গ্রোটোর গির্জার অধিকার তুর্কির সুলতানের কাছ থেকে হস্তগত করেন। কিন্তু এরপর তৃতীয় নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলে গ্রোটোর গির্জা সংক্রান্ত ফ্রান্সের পূর্বতন অধিকার প্রবলভাবে দাবী করেন।     

২. তৃতীয় নেপোলিয়নের উদ্দেশ্য :- 
গ্রোটোর গির্জা সংক্রান্ত ফ্রান্সের পূর্বতন অধিকার দাবী করার পেছনে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। তৃতীয় নেপোলিয়নের সিংহাসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল ক্যাথলিকদের সমর্থন। তাই তৃতীয় নেপোলিয়ন ক্যাথলিক ও অন্যান্য প্রভাবশালীদের সমর্থনলাভের উদ্দেশ্যে তুর্কি সুলতানের নিকট ফ্রান্সের সেই পূর্বতন অধিকার দাবী করেন। এছাড়া , এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার বিরোধিতা করার সুযোগটিও তৃতীয় নেপোলিয়নের কাছে আকর্ষণীয় ছিল।  


৩. তৃতীয় নেপোলিয়নের দাবীর প্রতি ক্যাথলিক রাষ্ট্রবর্গের সমর্থন :- 
গ্রোটোর গির্জার অধিকার সংক্রান্ত তৃতীয় নেপোলিয়নের দাবী ক্যাথলিক রাষ্ট্রগুলিকে উৎসাহিত করেছিল। অস্ট্রিয়া , স্পেন , সার্ডিনিয়া , পর্তুগাল , বেলজিয়াম সহ অন্যান্য ক্যাথলিক রাষ্ট্রগুলি তৃতীয় নেপোলিয়নের দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়। ফলে তৃতীয় নেপোলিয়নের দাবী আরো জোরদার হয় এবং তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। 

৪. তুর্কি সুলতানের ভূমিকা :- 
ইতিপূর্বেই তুর্কির সুলতান গ্রোটোর গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার ফ্রান্সকে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু ফরাসি বিপবের পর ফ্রান্সের দুর্বলতার সুযোগে রাশিয়া সেই অধিকার হস্তগত করে। কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়ন জোরালোভাবে ফ্রান্সের পূর্বতন অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবী জানালে তুরস্কের সুলতান ফ্রান্সকে সেই অধিকার প্রদান করেন এবং ল্যাটিন ধর্মযাজকদের সামান্য কিছু অধিকার প্রদান করেন। 

৫. রাশিয়ার দাবী ও জার নিকোলাসের উদ্দেশ্য :-
তুরস্কের সুলতান গ্রোটোর গির্জা সংক্রান্ত ফ্রান্সের সকল দাবী মেনে নিলে রাশিয়ার জার নিকোলাস অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি ফ্রান্সের অধিকার বাতিল করার জন্য তুরস্কের সুলতানের উপর চাপ তৈরী করতে থাকেন। আসলে জার নিকোলাসের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের সুলতানের অধীনস্থ অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপন। তাই তুরস্কের সুলতান রাশিয়ার দাবী মানতে অস্বীকার করলে জার নিকোলাস তুরস্কের মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া অধিকার করেন। এরফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরী হয়। 

৬. ইংল্যান্ডের ভূমিকা :- 
ইতিমধ্যে জার নিকোলাস তুরস্ক সম্পর্কে ইংল্যান্ডকে এক প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবে বলা হয় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মিলিতভাবে তুরস্ক দখল করবে এবং তুরস্ক বিজয় সম্পন্ন হলে তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। কিন্তু ইংল্যান্ড নিকট - প্রাচ্যে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত ছিল। তাই ইংল্যান্ড জার নিকোলাসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কেননা , ইংল্যান্ড বিশ্বাস করত তুরস্ক বর্তমানে ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি রূপে পরিচিত হলেও উপযুক্ত পরিস্থিতিতে তুরস্ক নিজের পূর্ব গৌরব ফিরে পেতে পারে। তাই তখন রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে তুরস্ক বিশেষভাবে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। 


৭. তুরস্কের আপোষ - প্রস্তাব :- 
গ্রোটোর গির্জার অধিকারকে কেন্দ্র করে তুরস্কের উপর রাজনৈতিক চাপ বেড়েই চলেছিল। একদিকে ফ্রান্স দাবী থেকে অনড় ছিল এবং অন্যদিকে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে তুরস্ককে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের সুলতান রাশিয়ার নিকট এক আপোষ প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু এই আপোষ প্রস্তাবে গ্রোটোর গির্জার অধিকার সরাসরি রাশিয়ার হাতে আসবে এমন কোনো উল্লেখ না থাকায় রাশিয়া এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তুরস্ক সুলতানের অধীনস্থ সকল অঞ্চলের সকল খ্রিস্টান প্রজাদের উপর অধিকারের দাবী জানায়। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। 

৮. অস্ট্রিয়ার ভূমিকা :- 
অস্ট্রিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এবং যুদ্ধের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ''শত্রুতাপূর্ণ নিরপেক্ষতা'' নীতি গ্রহণ করে। কেননা , পূর্ব ইউরোপ রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধির অর্থ ছিল অস্ট্রিয়ার প্রাধান্যকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া। তাই এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়া প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সকেই সমর্থন করে। এর পেছনে ছিল ক্যাভুরের মারাত্মক রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা। ক্যাভুর ঐক্যবদ্ধ ইতালি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সমর্থন লাভ করতে চেয়েছিলেন। 

৯. রুশ আক্রমণ ও ভিয়েনা নোট :- 
রাশিয়ার সকল দাবী অস্বীকার করা হলে রাশিয়া তুরস্ক আক্রমণ করে ও মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া প্রদেশ দুটি দখল করে। এই ঘটনা ইউরোপীয় রাজনীতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া সম্মিলিতভাবে শান্তি স্থাপনের প্রয়াস শুরু করে। তারা '' ভিয়েনা নোট '' নামক এক প্রস্তাব জার নিকোলাসের কাছে পাঠায়। কিন্তু তুরস্কের খ্রিস্টান জনগণ রাশিয়া কর্তৃক না তুরস্ক কর্তৃক রক্ষিত হবেন তা নিয়ে জার ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্ট্যান্ডফোর্ডের বাদানুবাদ সৃষ্টি হয় রাশিয়া সকল প্রকার শান্তি প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করেন। 

১০. তুরস্ক কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণা :- 
রাশিয়া শান্তি প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , পিডমন্ট - সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যোগদান করে এবং তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকলেও অস্ট্রিয়া রাশিয়ার প্রতি বিরোধিতামূলক নিরপেক্ষতা নীতি গ্রহণ করে। 
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকালের মধ্যেই জার নিকোলাসের মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে।  

You May Also Like

0 comments