কার্বনারি আন্দোলন কাকে বলে ? কার্বোনারি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব আলোচনা কর।
কার্বনারি আন্দোলন কাকে বলে ? কার্বোনারি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব আলোচনা কর।
কার্বনারি আন্দোলন ও তার উদ্দেশ্য :-
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে কার্বোনারি আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কার্বোনারি কথাটি এসেছে কার্বন অর্থাৎ অঙ্গার থেকে। কার্বোনারি সমিতির সদস্যরা জ্বলন্ত অঙ্গার বহন করে ইতালির মুক্তির আদর্শ প্রচার করত। ইতালির মুক্তিই ছিল কার্বনারিদের একমাত্র ব্রত।
বস্তুতঃপক্ষে কার্বোনারি ছিল একটি গুপ্ত সমিতি। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা সম্মেলনের আঘাতে ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কার্বোনারিদের হাত ধরেই ইতালির জাতীয়তাবাদ পুনরায় ফিনিক্স পাখির মত ভস্মস্তূপ থেকে নতুন করে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল।
কার্বোনারি সমিতির প্রধান কেন্দ্র ছিল নেপলস। কার্বোনারিদের উদ্দেশ্যগুলি ছিল -
(ক ) ইতালিতে বিদেশি শাসনের অবসান করে ইতালির স্বাধীনতা অর্জন।
(খ ) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা।
(গ ) ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা।
(ঘ ) নতুন সংবিধান প্রবর্তন করা।
(ঙ ) নৈতিকতা ও সমাজতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করা।
ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট (Marriott) বলেছেন , কার্বোনারিরা প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমত প্রতিষ্ঠা করে। এমনকি খ্রিস্টান ধর্মের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের আদর্শ জনগণের সামনে তুলে ধরে সমগ্র ইতালি জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কার্বোনারি আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :-
১. আত্মসমীক্ষার সুযোগ :-
কার্বোনারি আন্দোলন ইতালির জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সামনে আত্মসমীক্ষার সুযোগ প্রস্তুত করে। এতদিন পর্যন্ত কার্বোনারিরা মূলতঃ ষড়যন্ত্র , সশস্ত্র অভ্যুত্থান - ইত্যাদি কর্মপন্থা অনুসরণ করে চলত। এছাড়া আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িত ছিল। কিন্তু কার্বোনারি আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে ইতালির জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ নতুন ধরণের ও ত্রুটিমুক্ত কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
২. ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন :-
আপাতদৃষ্টিতে কার্বোনারি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। ইতালি থেকে বিদেশি শাসনের অবসান - যা ছিল কার্বোনারিদের মূল দাবী - তা তৎকালীন সময়ে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে কার্বোনারি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও কার্বোনারিদের সেই দাবী শীঘ্রই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
৩. ইতালির পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা :-
কার্বোনারি আন্দোলন ইটালিতে সংগঠিত পরবর্তী বৈপ্লবিক আন্দোলনগুলিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বিশেষ করে ম্যাৎসিনির ইয়ং ইতালি আন্দোলন কার্বোনারি আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল।
৪. রিসর্জিমেন্টো :-
রিসর্জিমেন্টো কথাটির অর্থ পুনর্জাগরণ ভিয়েনা সম্মেলন ইতালির জাতীয়তাবাদে প্রবল আঘাত হানলেও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগত দিকগুলি সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরী করে। তাই ইতালিতে কার্বনারী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ইতালিবাসীর পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে কার্বোনারি আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল।
৫. উদারনৈতিক আদর্শের প্রসার :-
ফরাসি বিপ্লব প্রসূত প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক আদর্শগুলি কার্বোনারিদের মাধ্যমে সমগ্র ইতালি জুড়ে প্রসারিত হয়। ফলে কার্বোনারি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও সেই আদর্শগুলির প্রভাব মুছে ফেলা যায়নি।
৬. রক্ষণশীলতার বিরোধিতা :-
১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন ইতালি সহ সমগ্র ইউরোপকে রক্ষনশীলতার চাদরে মুড়ে ফেলেছিল। বলা বাহুল্য যে , ভিয়েনা সম্মেলন ছিল ইউরোপীয় প্রগতিশীলতার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। কিন্তু কার্বোনারিরা ভিয়েনা সম্মেলনের রক্ষণশীল নীতির তীব্র বিরোধিতা করে এবং প্রগতিশীল সংস্কার ও উদারনৈতিক আদর্শগুলি প্রতিষ্ঠার দাবী জানায়। ফলে ইউরোপীয় জনগণের মধ্যে আশার আলো যুগিয়েছিল।
৭. অস্ট্রিয়ার স্বরূপ উন্মোচন :-
কার্বোনারি আন্দোলনের ফলেই ইউরোপে অস্ট্রিয়ার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়। সীমাহীন বর্বরতা , অত্যাচার ও নিষ্ঠুর দমন নীতি প্রয়োগ করে কার্বোনারি আন্দোলনসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে অস্ট্রিয়া দমন করে। তাই কার্বোনারি আন্দোলনের ফলেই ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অস্ট্রিয়া বিরোধী হয়ে ওঠে।
৮. বৈপ্লবিক সাহিত্যের প্রসার :-
কার্বোনারি আন্দোলনের হাত ধরে ইতালিতে বৈপ্লবিক সাহিত্যের প্রসার তীব্রতর হয়। এই সকল সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচলিত রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা , ব্যক্তি স্বাধীনতা , নাগরিক অধিকার - ইত্যাদি প্রগতিশীল আদর্শের প্রচার করা হয় এবং সর্বপরি ইতালি থেকে বৈদেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে না পারলে ইতালির উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয় - তা জনসাধারণের নিকট উপস্থাপন করা হয়। এইসকল সাহিত্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ক্যাভুর সম্পাদিত রিসর্জিমেন্টো পত্রিকা।
৯. ইতালিবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার :-
কার্বোনারি সমিতির সদস্যগণ ইতালিবাসীর মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছিল - তা ছিল কার্বোনারি আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী সাফল্য। কার্বোনারি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও সেই চেতনা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। মানুষ উপলব্ধি করেছিল ইতালির স্বাধীনতা অর্জন ব্যতীত অন্য কোনো পথেই ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
কার্বোনারি আন্দোলন কতটা সফল হয়েছিল - সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ে কার্বোনারি আন্দোলন এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল - সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
0 comments