­
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল , প্রভাব , গুরুত্ব। - NANDAN DUTTA

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল , প্রভাব , গুরুত্ব।

by - May 02, 2025

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল , প্রভাব , গুরুত্ব।  




ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল , প্রভাব , গুরুত্ব।  

ইউরোপের ইতিহাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের তাৎপর্য বিবেচনা করে ঐতিহাসিক লর্ড ক্রোমার ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে ''ইউরোপের ইতিহাসের জলবিভাজিকা '' রূপে উল্লেখ করেছেন। আবার অন্যদিকে রবার্ট মরিয়ার মন্তব্য করেছেন - তৎকালীন সংগঠিত যুদ্ধগুলির মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ছিল একান্তই সার্থকতাবিহীন যুদ্ধ। লর্ড সলসবেরি অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষায় - '' England put her money on the wrong horse.''  । 
তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব বিষয়ে মতভেদ থাকলেও ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল উভয়ই প্রাসঙ্গিক। 

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল :- 


১. প্যারিসের সন্ধি :- 
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তগুলি ছিল - 
(ক ) মোলডেভিয়া ও ওয়ালাকিয়া - র প্রদেশদুটি রাশিয়া তুরস্ককে প্রত্যার্পণ করে। 
(খ ) তুরস্কের খ্রিস্টান প্রজাবর্গের রক্ষণাবেক্ষণের দাবী রাশিয়া পরিত্যাগ করে। 
(গ ) কৃষ্ণসাগরের উপর থেকে কোনো একক শক্তির আধিপত্য অস্বীকার করে তাকে নিরপেক্ষ রাখা হল।(ঘ ) দানিউব নদীকে আন্তর্জাতিক নদী বলে ঘোষণা করা হল ; ফলে দানিউব নদীর উপর সকল রাষ্ট্রের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(ঙ ) তুরস্ক সার্বিয়ার স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে। 
(চ ) রাশিয়া তুরস্ককে বেসারবিয়া ফিরিয়ে দেয়। 

২. রাশিয়ার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় :- 
প্যারিসের সন্ধিতে স্পষ্টরূপে রাশিয়ার অগ্রগতি প্রতিরোধ  করা হয়। ইতিপূর্বে রাশিয়া তুরস্কের মোলডেভিয়া ও ওয়ালাকিয়া প্রদেশদুটি দখল করলেও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে উভয় প্রদেশই রাশিয়ার হাতছাড়া হয়। কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সকল দুর্গ ও সেনাশিবির রাশিয়া সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তুরস্ককে কেন্দ্র করে নিকট - প্রাচ্যে রাশিয়া শক্তিবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখেছিল - তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 


৩. তুরস্কের রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ :- 
প্যারিসের সন্ধি দ্বারা তুরস্ক রাশিয়ার আগ্রাসনের হাত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তিলাভ করে। তুরস্ককে ইউরোপীয় রাষ্ট্রমন্ডলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিবর্গের তুরস্ককে কেন্দ্র করে নিজ নিজ স্বার্থ জড়িত ছিল। তারা তুরস্ককে রাজনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। রাজনৈতিক উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি পেয়ে তুরস্ক অভ্যন্তরীণ সংস্কারে মনোনিবেশ করার সুযোগ পায়। 

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল :- 


৪. রাশিয়ায় সংস্কার কর্মসূচির সূচনা :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে রাশিয়া তার পুরাতনতন্ত্র ও সংস্কার বিমুখতাকে দায়ী করে। এর ফলে রাশিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল সংস্কার সাধন করা হয়। জার আলেকজান্ডার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ করেন। 

৫. ইউরোপ সম্পর্কে রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইউরোপ সম্পর্কে রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির পরিবর্তন ঘটে। রাশিয়ার জার ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান সমর্থক হলেও ইউরোপীয় শক্তিবর্গ প্যারিস সম্মেলনের মাধ্যমে রাশিয়ার বিজিত অচলগুলি কেড়ে নেয়। কৃষ্ণ সাগর এলাকাতেও রাশিয়ার অগ্রগতি প্রতিরোধ করা হয়। ফলে রাশিয়া ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে এশিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করে। 

৬. রাশিয়ার এশিয়া নীতি :- 
ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর রাশিয়া এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে। মোঙ্গলিয়ার কিছু অংশ , ককেশাস অঞ্চল , সমরখন্দ , বোখারা - ইত্যাদি অঞ্চল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও রাশিয়ার সেনাবাহিনী আফগানিস্তান পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং ভারতেও রুশ আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। 

৭. তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়লাভের ফলে ফ্রান্স তথা ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজনৈতিক মর্যাদা ও গুরত্ব প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্স সমগ্র ইউরোপে শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ইউরোপের সকল ক্ষেত্রে তৃতীয় নেপোলিয়ন নিয়ন্ত্রকের মর্যাদায় উন্নীত হন। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় নেপোলিয়ন চেয়েছিলেন ফ্রান্সের শক্তিবৃদ্ধি করে ভিয়েনা চুক্তি ভেঙে ফেলতে। 


৮. ইংল্যান্ডের বিপুল ক্ষতি :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় এবং ইংল্যান্ড ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ইংল্যান্ড একটি দুর্বল অর্থনীতিতে পরিণত হয়। মিত্রপক্ষ জয়লাভ করলেও যেহেতু ইংল্যান্ডের প্রত্যক্ষ কোনো লাভ হয়নি , সেহেতু ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর ইউরোপে ইংল্যান্ডের মর্যাদাহানি ঘটে। 

৯. ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠা :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল হিসাবে ইটালির ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। যেহেতু ইতালি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে মিত্রপক্ষের হয়ে যোগদান করে , তাই যুদ্ধের পর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ক্যাভুরের নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য আন্দোলনে পিডমন্টের পক্ষ অবলম্বন করেন। ক্যাভুর প্যারিস সম্মেলনে ইতালির সমস্যাকে সমগ্র ইউরোপের সমস্যারূপে উপস্থাপিত করতে সফল হন এবং ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সাহায্য নিয়ে ক্যাভুর অস্ট্রিয়ার হাত থেকে ইতালির মুক্তি ছিনিয়ে নেন। 

১০. জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠা :- 
যেহেতু প্রাশিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছিল , তাই রাশিয়ার জার প্রাশিয়ার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করায় জার অস্ট্রিয়ার প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাই বিসমার্ক যখন ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তখন রাশিয়া বিসমার্ককে সহায়তা স্বরূপ অস্ট্রো - প্রাশিয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকেন। ফলে বিসমার্ক সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করেন। 

১১. বলকান জাতীয়তাবাদের প্রসার :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল বলকান জাতীয়তাবাদীদের উৎসাহিত করে। বলকান জাতীয়তাবাদীরা নতুন উদ্যমে সংগঠিত হয় ও তাদের স্বাধীনতার দাবী জোরালো হয়। এ প্রসঙ্গে ক্রোমার বলেছেন - A fresh movement was set on foot towards Balkan reconstruction.  ।  বস্তুতঃপক্ষে ক্রোমার বলকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পেছনে ক্রিমিয়ার যুদ্ধকেই একমাত্র কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।   

১২. আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এক অভিনব ও কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করে। ঠিক হয় , ইউরোপীয় শক্তিগুলি পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে আন্তর্জাতিক সভা আহ্বান করা হবে এবং সেখানেই আলাপ - আলোচনার মাধ্যমে সকল প্রকার বিরোধের মীমাংসা করার চেষ্টা করা হবে। 

পরিশেষে বলা যায় , ইউরোপের ইতিহাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক ; সুদূরপ্রসারী নয়। তবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে পরোক্ষভাবে ইতালির ঐক্য ও জার্মানির ঐক্য সংগঠিত হয় এবং তৃতীয় নেপোলিয়ন ভিয়েনা চুক্তি ভাঙতে চেষ্টা করেন - এই ঘটনাগুলি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায়না।   

You May Also Like

0 comments