­
জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের ভূমিকা। - NANDAN DUTTA

জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের ভূমিকা।

by - April 28, 2025

জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের ভূমিকা। 




জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের ভূমিকা। 

অটো ভন বিসমার্ক ছিলেন ঐক্যবদ্ধ জার্মানি প্রতিষ্ঠার মূল কান্ডারি। সুদীর্ঘ আট বছর প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছর জার্মানির প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়কালে তিনি জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ইতিপূর্বে উদারনৈতিক পথে জার্মানির ঐক্য সাধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল ; কিন্তু তা সফল হয়নি। তাই উদারনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে বিসমার্ক কঠোর '' রক্ত ও লৌহ '' নীতি গ্রহণ করেন। তারপর ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ , অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ , ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ - ইত্যাদি বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। 

১. বিসমার্কের আদর্শগত অবস্থান :- 
আদর্শগত দিক দিয়ে বিসমার্ক কঠোর অবস্থানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। তাই তিনি চেয়েছিলেন প্রাশিয়ার রাজশক্তির অধীনে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এছাড়া তৎকালীন জার্মানির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রকেই তিনি শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। তাই জার্মানির ঐক্য দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি রক্ত ও লৌহ নীতি গ্রহণ করেন। 

২. ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ :- 
১৮৬৩  সালে স্লেজভিগ ও হলস্টিন প্রদেশে এক রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। বিসমার্ক এই সমস্যাকে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কেননা , হলস্টিনের অধিবাসীরা ছিল অধিকাংশ জার্মান। আবার অন্যদিকে জার্মানরা মনে করতেন স্লেজভিগ ছিল হলস্টিনের অন্তর্গত। বিসমার্ক স্লেজভিগ ও হলস্টিন উভয় প্রদেশকেই জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান। এরপর প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যৌথবাহিনী ডেনমার্ককে পরাজিত করে। 


৩. গ্যাস্টিনের সন্ধি ১৮৬৫:- 
ডেনমার্ক যুদ্ধে পরাজিত হলেও স্লেজভিগ ও হলস্টিন প্রদেশের অধিকার নিয়ে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিরোধ তৈরী হয়। এরপর ১৮৬৫ সালে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে গ্যাস্টিনের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি দ্বারা স্লেজভিগ প্রাশিয়ার অধিকারে এবং হলস্টিন অস্ট্রিয়ার অন্তর্গত হয়। এছাড়া , অর্থের বিনিময়ে অস্ট্রিয়া হলস্টিনের অন্তর্গত লাউয়েনবার্গ অঞ্চল প্রাশিয়াকে ছেড়ে দেয়। কূটনৈতিক দিক দিয়ে গ্যাস্টিনের সন্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা , এই সন্ধির আবহেই বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। 

৪. অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি :- 
গ্যাস্টিনের সন্ধিকে বিসমার্ক মনে করতেন - to paper over the cracks অর্থাৎ কাগজ দ্বারা ফাটল বন্ধ করা। গ্যাস্টিনের সন্ধির আবহে বিসমার্ক উপলব্ধি করেন জার্মানির ঐক্য সাধনে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যতে যুদ্ধ অনিবার্য। তাই কূটনৈতিকভাবে প্রাশিয়াকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(ক ) ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নকে বেলজিয়াম বা রাইন অঞ্চল প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্রান্সের সমর্থন লাভ করেন। 
(খ ) ইতালিকে ভেনেসিয়া প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইতালিকে নিজ পক্ষে টেনে আনেন। 
(গ ) পোল্যান্ডের বিদ্রোহ দমন করতে রাশিয়াকে সাহায্য করে তিনি রাশিয়ার সমর্থন লাভ করেন। 

৫. স্যাডোয়ার যুদ্ধ :-
এরপর বিসমার্ক জার্মান রাষ্ট্র-সংঘ থেকে নিজেদের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রাশিয়া ফ্রান্স , ইতালি ও রাশিয়ার সমর্থনলাভ করে এবং ব্যাভেরিয়া , স্যাক্সনি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি অস্ট্রিয়াকে সমর্থন জানায়। তবে প্রাশিয়ার সম্মিলিত সামরিক শক্তি ছিল অস্ট্রিয়ার তুলনায় অধিক শক্তিশালী। এরপর ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্যাডোয়ার যুদ্ধে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে অস্ট্রিয়া পরাজিত হয়। স্যাডোয়ার যুদ্ধের মূল গুরুত্ব ছিল এই যে স্যাডোয়ার যুদ্ধের ফলে সমগ্র জার্মান সাম্রাজ্য প্রাশিয়ার অধীনস্থ হয়। 

৬. প্রাগের সন্ধি :- 
অবশেষে প্রাগের সন্ধি দ্বারা স্যাডোয়ার যুদ্ধের অবসান হয়। প্রাগের সন্ধির শর্তগুলি ছিল - 
(ক ) প্রাশিয়ার নেতৃত্বে উত্তর-জার্মান ইউনিয়ন গঠিত হবে। 
(খ ) মেইন নদীর দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলি নিজেদের রাষ্ট্রসঙ্ঘ গঠন করবে। 
(গ ) জার্মান রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে প্রাশিয়া নিজেকে সরিয়ে নেয়। 
(ঘ ) ইতালি ভেনেসিয়া অঞ্চল লাভ করে। 
(ঙ ) যুদ্ধের জন্য অস্ট্রিয়া প্রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। 
(চ ) উত্তর জার্মানির হ্যানোভার , ফ্রাঙ্কফুর্ট , ন্যাসো - ইত্যাদি অঞ্চলগুলি প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। 
(ছ ) স্লেজভিগ ও হলস্টিন উভয় প্রদেশই প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। 

৭. ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ :- 
গ্যাস্টিনের সন্ধি ও প্রাগের সন্ধি দ্বারা উত্তর জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হলেও দক্ষিণ জার্মানিতে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। অতঃপর বিসমার্ক ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। প্রাশিয়াতে শাসন ক্ষমতা ছিল হোহেনজোলার্ন রাজবংশের হাতে। ফ্রান্স মনে করত হোহেনজোলার্ন রাজবংশের অধীনে প্রাশিয়া ও স্পেন - উভয়ের ক্ষমতা এলে তা হবে ফ্রান্সের রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। তাই ফ্রান্স কখনোই চায়নি যে স্পেনের সিংহাসনে হোহেনজোলার্ন রাজবংশের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। এই উদ্দেশ্যে ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরোধিতা করতে থাকে এবং প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। 


৮. বিসমার্কের ষড়যন্ত্র :- 
এই পরিস্থিতে বিসমার্ক প্রবল কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি প্রাশিয়ার অর্থ ও নিজ প্রভাব খাটিয়ে স্পেনের রানী ইসাবেলাকে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। স্পেনের পার্লামেন্টকে বিসমার্ক নিজ করায়ত্ত করেন এবং স্পেনের পার্লামেন্ট হোহেনজোলার্ন বংশের যুবরাজ লিওপোল্ডকে স্পেনের সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তাব দেয়। এই ঘটনায় ফ্রান্সে প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। 

৯. এমস টেলিগ্রাম :- 
এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার স্মরণাপন্ন হয় এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের আদেশে কাউন্ট বেনেদিতি নামক এক দূতকে প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়ামের নিকট প্রেরণ করেন। প্রথম উইলিয়াম এইসময় এমস শহরে বিশ্রামরত অবস্থায় ছিলেন। কাউন্ট বেনেদিতি প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়ামের নিকট মুচলেখা দাবী করেন যে স্পেনের সিংহাসনে প্রাশিয়ার উত্তরাধিকার প্রতিষ্টিত হবেনা। কিন্তু প্রথম উইলিয়াম প্রস্তাবে সম্মত হলেও মুচলেখা দিতে অস্বীকার করেন। কাউন্ট বেনেদিতি এই ঘটনা টেলিগ্রামের মাধ্যমে বিসমার্ককে জানান। 

১০. সেডানের যুদ্ধ :- 
সুচতুর বিসমার্ক সেই টেলিগ্রামের কিছু অংশ পরিবর্তন করে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন। টেলিগ্রামের অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে তার অর্থ হয় যে - প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়াম ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে অপমানিত করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এই ঘটনা ফ্রান্সে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিল। কেননা , ইতিপূর্বে বিসমার্ক কূটনীতির মাধ্যমে ইউরোপে ফ্রান্সকে মিত্রহীন করে তুলেছিলেন। এছাড়া , ব্যাভেরিয়া ও অন্যান্য দক্ষিণের রাজ্যগুলি ফ্রান্সকে ছেড়ে প্রাশিয়ার পক্ষে যোগদান করে। ফলে যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। 

১১. ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সন্ধি ১৮৭১ :- 
অবশেষে ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সন্ধি দ্বারা সেডানের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সন্ধিতে স্থির হয় - 
(ক ) ফ্রান্স জার্মানিকে মেটজ (Metz), আলসেস ও নোরেন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। 
(খ ) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৫০০ কোটি ফ্রাঁ প্রাশিয়াকে দিতে বাধ্য হয়। 
(গ ) ক্ষতিপূরণের অর্থ শোধ না হওয়া পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সের বিভিন্ন অংশে মোতায়েন থাকবে বলে স্থির হয়। 

১২. সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে জার্মানির আত্মপ্রকাশ :- 
বিসমার্কের অসাধারণ বিচক্ষণতা ও কূটনৈতিক দক্ষতায় মাত্র তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র জার্মানির ঐক্য সাধন করেন। ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধের পর গ্যাস্টিনের সন্ধি দ্বারা স্লেজভিগ অঞ্চল প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় ; অস্ট্রিয়ার সঙ্গে স্যাডোয়ার যুদ্ধের পর প্রাগের সন্ধি দ্বারা উত্তর জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয় ; ফ্রান্সের সঙ্গে সেডানের যুদ্ধের পর ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সন্ধি দ্বারা সমগ্র দক্ষিণ জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়ামকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে ঘোষণা করা হয়।   

You May Also Like

0 comments