­
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের ভূমিকা। - NANDAN DUTTA

ইতালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের ভূমিকা।

by - April 27, 2025

ইতালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের ভূমিকা। 



ইতালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের ভূমিকা। 


কাউন্ট ক্যাভুর ছিলেন ইতালির ঐক্য আন্দোলনের একজন বাস্তববাদী নেতৃত্ব। ইতিপূর্বে ম্যাৎসিনি যে প্রজাতন্ত্রিক আদর্শের বীজ বপন করেছিলেন , ক্যাভুর সম্পূর্ণ ভিন্নপথে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। ক্যাভুর বিশ্বাস করতেন বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া ইতালি অস্ট্রিয়ার পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া কোনোভাবেই ইতালির পক্ষে সম্ভব নয়। ম্যাৎসিনি ইতালিবাসীকে জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেছিলেন ঠিকই ; কিন্তু ইতালির ঐক্য বাস্তবে সম্পন্ন করেছিলেন ক্যাভুর। তাই ঐতিহাসিক ফিলিপস বলেছেন - Cavour was the maker of modern Italy.   । 

১. ক্যাভুরের মতাদর্শ ও নীতি :- 
ক্যাভুর ম্যাৎসিনির প্রজাতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক। ক্যাভুর মনে করতেন ইতালিতে প্রজাতান্ত্রিক ভাবাদর্শের বিকাশ ঘটলে ইতালির রাজতান্ত্রিক ঐক্য ব্যাহত হবে এবং ইতালির ঐক্যের স্বপ্ন চরিতার্থ হবেনা। তাই ক্যাভুর পিডমন্ট রাজবংশের অধীনে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। 
এছাড়া , অস্ট্রিয়ার পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে তিনি বৈদেশিক শক্তির সাহায্য গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। কেননা , তৎকালীন সময়ের বাস্তবতা ছিল এই যে - ইতালি সামরিক শক্তির দিক দিয়ে কোনোভাবেই অস্ট্রিয়ার সমকক্ষ ছিল না। ক্যাভুরের এই মতাদর্শ স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন Real Politik বা বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী।     

২. কর্মপন্থা :- 
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে ক্যাভুরের ভূমিকার ইতিহাস আলোচনা করলে কর্মপন্থার দিক দিয়ে মূলতঃ পাঁচটি নীতির সমাবেশ চোখে পড়ে। এই পাঁচটি কর্মপন্থা হল - 
(i) পিডমন্টের রাজশক্তির অধীনে ইতালির ঐক্য সাধন করা। 
(ii) শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার। 
(iii) ইতালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভ করা। 
(iv) অস্ট্রিয়ার পরাধীনতা থেকে মুক্তিলাভ করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। 
(v) আইনের সাম্য প্রতিষ্ঠা করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। 


৩. ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ও ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের সমর্থন লাভ :- 
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পিডমন্টের সেনাবাহিনীকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পক্ষে নিয়োজিত করেন। এর পেছনে ক্যাভুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মত উদারনৈতিক রাষ্ট্রগুলির সহায়তালাভ।    ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে ইতালির সমস্যাকে যথার্থভাবে তুলে ধরতে ক্যাভুর সক্ষম হন। ইতালির সমস্যার যথাযথ সমাধান না হলে তা ইউরোপীয় ঐক্যের পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে - একথা তিনি ইউরোপীয় উদারনৈতিক শক্তিগুলিকে মেনে নিতে বাধ্য করেন। 

৪. প্লোমবিয়ার - এর চুক্তি ১৮৫৮ :- 
ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্রজাতন্ত্রের  প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন কেননা তিনি নিজে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করেছিলেন ; তাই তিনি ক্যাভুরের রাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এছাড়াও তৃতীয় বৈদেশিক নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে সহায়তা করে ভিয়েনা চুক্তি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা। অন্যদিকে ক্যাভুর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নোপোলিয়নের সাহায্যলাভের প্রত্যাশী ছিলেন। ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় নেপোলিয়ন ও ক্যাভুরের মধ্যে প্লোমবিয়ার - এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে স্থির হয় - 
(i) পিডমন্ট অস্ট্রিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হলে তৃতীয় নেপোলিয়ন সামরিক সাহায্য প্রদান করবেন। 
(ii) লোম্বার্ডি , ভেনেসিয়া ও পোপের রাজ্যের কিছু অংশ পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। 
(iii) স্যাভয় ও নিস নেপোলিয়নকে প্রদান করা হবে। 
(iv) নেপলস ও সিসিলিতে বুরবোঁ রাজতন্ত্র বহাল থাকবে। 
(v) টাস্কানি ও পোপের রাজ্যের বড় অংশ নিয়ে মধ্য ইতালি গঠন করা হবে। 

৫. অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ :- 
ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে প্লোমবিয়ার - এর চুক্তির পর ক্যাভুর অস্ট্রিয়া অধিকৃত লোম্বার্ডি ও ভেনেসিয়া অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। অস্ট্রিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যাভুরকে চরমপত্র পাঠালে ক্যাভুর তা অগ্রাহ্য করেন। এরপর অস্ট্রিয়া পিডমন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে প্লোমবিয়ার - এর চুক্তি অনুসারে তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসি বাহিনীকে পিডমন্টের পক্ষে নিয়োজিত করেন। ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হয় এবং ফরাসি বাহিনী লোম্বার্ডি দখল করে। ফলে সমগ্র ইতালি জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। 

৬. ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি :- 
ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলেও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন হঠাৎ অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি সাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের কথা ঘোষণা করে। ইতালিকে অস্ট্রিয়ার হাত থেকে মুক্ত করার আশা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধির শর্তগুলি ছিল - 
(i) ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। 
(ii) লোম্বার্ডি পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হবে। 
(iii) ভেনেসিয়া অস্ট্রিয়ার অধীনেই থাকবে। 
(iv) ইতালিতে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। 
ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি ছিল ইতালীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি তৃতীয় নেপোলিয়নের বিশ্বাস ঘাতকতা। কিন্তু পিডমন্টের সম্রাট বাস্তবতা বিচার করে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধির শর্তগুলি মেনে নেন। 


৭. মধ্য ইতালির সংযুক্তি :- 
ইতিমধ্যে মধ্য ইতালির অন্তর্গত টাস্কানি , মেডোনা - ইত্যাদি অঞ্চলগুলিতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন শুরু হয়। তবে এই আন্দোলন ছিল ম্যাৎসিনির প্রজাতান্ত্রিক ভাবাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত। এই সকল অঞ্চলের মানুষ পিডমন্টের সঙ্গে সংযুক্তির দাবী জানায়। ক্যাভুরের নিয়মতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী হলেও ক্যাভুর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তিনি স্যাভয় ও নিস ফ্রান্সকে ছেড়ে দিয়ে মধ্য ইতালির অবশিষ্ট রাজ্যগুলিকে পিডমন্টের সঙ্গে যুক্তকরণের ক্ষেত্রে তৃতীয় নোপোলিয়নের সমর্থন আদায় করেন। এরপর গণভোট দ্বারা মধ্য ইতালির রাজ্যগুলি পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। 

৮. গ্যারিবল্ডি ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা :- 
দক্ষিণ ইতালিতে বুরবোঁ অপশাসনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন শুরু হলে ইটালির জাতীয়তাবাদী নেতা গ্যারিবল্ডি ১০৯০ জনের এক গেরিলা বাহিনীর সাহায্যে সিসিলি থেকে বুরবোঁ সেনাদের বিতাড়িত করেন। কৃষকেরা তাঁকে মুক্তিদাতা বলে মনে করে। এরপর নেপলসে একই ঘটনার পুনরাবর্তন ঘটে এবং নেপলস থেকেও বুরবোঁ সেনাদল বিতাড়িত হয়। এরপর ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্যারিবল্ডি রোম অভিযানের পরিকল্পনা করেন। 
গ্যারিবল্ডির এই ঘোষণার ফলে ক্যাভুর সমস্যায় পড়েন। কেননা , গ্যারিবল্ডি ছিলেন ম্যাৎসিনির প্রজাতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। গ্যারিবল্ডির  অভিযানের ফলে রোমে যদি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হত - তাহলে তা ঐক্যবদ্ধ ইতালি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক হত না। 

৯. দক্ষিণ ইটালির সংযুক্তি :- 
উক্ত পরিস্থিতিতে প্রবল বিচক্ষণ ক্যাভুর তৃতীয় নেপোলিয়নকে বোঝাতে সমর্থ হন যে ইউরোপীয় স্থিতাবস্থা ও ঐক্য বজায় রাখতে রোম , নেপলস ও সিসিলিকে অবিলম্বে পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। তৃতীয় নেপোলিয়নের সমর্থন পেয়ে পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইম্যানুয়েল রোম বাদ দিয়ে পোপের অধিকৃত রাজ্য দখল করে নেপলসে উপস্থিত হন। 
এই পরিস্থিতিতে গ্যারিবল্ডি যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না এবং সিসিলি ও নেপলস - এর অধিকার তিনি ছেড়ে দেন। ফলে সিসিলি ও নেপলস পিডমন্টের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। 

১০. অবশিষ্ট ইতালির সংযুক্তি :- 
ইতালির পূর্ণাঙ্গ ঐক্যবদ্ধরূপ ক্যাভুর নিজের জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষ করে যেতে পারেনি। ১৮৬১ সালে পিডমন্টের সম্রাট ভিক্টর ইম্যানুয়েল ইটালির রাজা হিসাবে ভূষিত হন। ১৮৬৩ সালে ভেনেসিয়া ইতালির সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৮৭০ সালে ফরাসি সেনাদলকে রোম থেকে বিতাড়িত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে ভিক্টর ইম্যানুয়েল রোম অধিকার করেন এবং রোমকে ইতালির রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। এইভাবে ইতালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , ম্যাৎসিনি ইতালিবাসীর ভাবজগতে জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করেছিলেন তাকে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষরূপে গড়ে তোলেন কাউন্ট ক্যাভুর। তাই ক্যাভুরকে প্রকৃত অর্থে আধুনিক ইতালির জনক বলা হয়। ইতালির ঐক্যবদ্ধকরণে ক্যাভুরের ভূমিকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন - He lived long enough to create the Italy and to earn the undying gratitude of the Italian people. 
তবে গর্ডন ক্রেইগ - প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ক্যাভুরের কর্মপন্থাকে প্রবলভাবে সমালোচনা করেছেন। কেননা , ক্যাভুর ম্যাৎসিনির গণতান্ত্রিক আদর্শগুলি বিসর্জন দিয়েছিলেন। এছাড়া , ডেভিড  থমসন , গ্রেনভিল - প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ক্যাভুরকে নব্য ইতালির প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কৃতিত্ব দিতে চাননি। তাঁরা ক্যাভুরকে কেবলমাত্র বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ হিসাবে কৃতিত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী। 
তবে , কিছু সমালোচনা স্বত্তেও একথা অনস্বীকার্য যে আধুনিক ইতালির গঠনে ক্যাভুরের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।  

You May Also Like

0 comments