হোসেনসাহি বংশ : বাংলার ইতিহাসে হোসেনসাহি বংশের অবদান।

by - July 13, 2022

হোসেনসাহি বংশ : বাংলার ইতিহাসে হোসেনসাহি বংশের অবদান। 

বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হোসেনসাহি বংশের অবদান। 



 

বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হোসেনসাহি বংশের অবদান। 

বাংলায় হোসেনশাহি শাসনের সূচনা ছিল দুই ভাবে উল্লেখযোগ্য - অরাজকতার অবসান ও গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা। বাংলায় ইলিয়াসশাহি শাসনের পর হাবসি শাসন শুরু হয়। কিন্তু হাবসি শাসনে বাংলায় রাজনৈতিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক - সর্বক্ষেত্রে অরাজকতা দেখা যায়। প্রায় অর্ধ - শতাব্দীর শাসনকালে ( ১৪৯৩ - ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ ) হোসেনসাহি সুলতানগন অরাজকতা দমন করে বাংলার সর্বত্র এক শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবেশ রচনা করেছিলেন। হোসেনসাহি শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকাল ছিল সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। 


১. অরাজকতা দমন ও স্থিতিশীল শাসনের প্রতিষ্ঠা :- 
হাবসি শাসনকালে বাংলায় যে অরাজকতা দেখা দিয়েছিল হোসেনসাহি শাসকেরা সেই অরাজকতা দমন করে এক স্থিতিশীল শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। এক্ষেত্রে সুলতান হোসেন শাহের অবদান সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও নসরৎ শাহের রাজত্বকালকে বি এন রায় মধ্য যুগের বাংলার সর্বাপেক্ষা গৌরবজনক অধ্যায় বলে অভিহিত করেছেন। এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফলে বাংলার সর্বত্র অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন বিকশিত হয়।

২. বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা :- 
হোসেনসাহি শাসকগণ দিল্লির সুলতান ও পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাজ্যগুলির হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সমর্থ হয়েছিলেন। এমনকি সিকান্দার আক্রমণকে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেন হোসেনসাহি শাসকেরা। বাংলাকে দিল্লির সুলতানি শাসনের নিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে গড়ে তুলতে হোসেনসাহি শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য। 

৩. হিন্দু -মুসলিম সমন্বয়ের নীতি :- 
সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তাবিধানের জন্য হোসেনসাহি শাসকেরা এক ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য হিন্দুদের প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। সমকালীন বাংলার ইতিহাসে এই নিরপেক্ষতার নীতি ছিল অপরিহার্য। ঐতিহাসিক তরফদার বলেছেন - Such a secular policy was inherent in the logic of Bengal History. । এই প্রসঙ্গে সেনাপতি গৌড় মল্লিক , চিকিৎসক মুকুন্দ , সচিব রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী - প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

৪. সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ :- 
হুসেনসাহি আমলে বাংলার রাষ্ট্রীয় সীমানা পশ্চিমে ত্রিহুত , দক্ষিণ - পশ্চিমে উড়িষ্যার কিছু অংশ , উত্তর - পূর্বে কুচবিহার ও দক্ষিণে চট্টগ্ৰাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিল। হোসেন শাহ ও নসরৎ শাহ আফগান শক্তিকে নিয়ে একটি শক্তিসংঘ গঠন করেন যা সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তাবিধান - উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকরী হয়। 


৫. জাতীয় চেতনার বিকাশ :- 
হুসেনসাহি আমলে ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন ও প্রশাসনিক স্থিতাবস্থা জাতীয় চেতনার বিকাশে সহায়ক হয়।হুসেনশাহি শাসকেরা বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিলেন। এর ফল হিসাবে , বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু - মুসলিম সমন্বয়সাধন তৈরী হয় ; যা বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে জাতীয় চেতনার বিকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে। হিন্দু - মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যৌথভাবে বাংলার বিকাশে আত্মনিয়োগ করেন। 

৬. সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজাগরণ :- 
হোসেনসাহি আমলে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি উত্তর ভারতের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করে। কেবলমাত্র স্থানীয় মনীষার উপর ভিত্তি করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। হোসেনসাহি শাসকেরা এই নতুন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই সময় বাংলা ভাষা ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। এছাড়াও এই সময়কালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চৈতন্যদেবের আবির্ভাব। 

৭. সাহিত্যে উৎকর্ষতা :- 
এই সময়কালে সৈয়দ আলাওল ও দৌলত কাজীর রচনায় ভাববাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত ভাষাও উৎকর্ষতা লাভ করে। মালাধর বসু , যশোরাজ খাঁ ,কবীন্দ্র পরমেশ্বর , শ্রীধর , বিজয় গুপ্ত - প্রমুখের নাম সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু ভগবৎ গীতার বাংলা অনুবাদ করেন। এই কাজের জন্য হোসেন শাহ তাঁকে ' গুণরাজ খাঁ ' উপাধি প্রদান করেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তিগুলি হল - কৃষ্ণদাস কবিরাজের ' চৈতন্যচরিতামৃত ' , বিপ্রদাসের ' মনসামঙ্গল ' ও জয়ানন্দের ' চৈতন্যমঙ্গল ' - ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্য , দর্শন , স্মৃতিশাস্ত্র , ব্যাকরণ , ন্যায়শাস্ত্র - ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবদ্বীপ সেই সময়ে পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। 

৮. স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ :- 
হুসেনশাহী আমলে বাংলার স্থাপত্য শিল্প বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। গৌড়ের গুণমন্ত মসজিদ ,বড়সোনা মসজিদ , হোসেন শাহের সমাধির উপর এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে নির্মিত একলাখি মসজিদ - ছিল এই যুগের স্থাপত্য শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ঐতিহাসিক ফার্গুসন বড়সোনা মসজিদকে গৌড়ের সর্বোৎকৃষ্ট সৌধ বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও এই সময়ে অগণিত মসজিদ , মক্তব , মাদ্রাসা , খানকা , প্রাসাদ , দরগা - ইত্যাদি গড়ে ওঠে। 

৯. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি :- 
হোসেনসাহি আমলে স্থানীয় ও বহির্বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সমুদ্রপথে শ্রীলংকা , ইন্দোচীন , ইন্দোনেশিয়া , ব্রহ্মদেশ , সুমাত্রা - ইত্যাদি দেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্য চলতো। উপকূলবর্তী শহরগুলো পণ্য কেনাবেচার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। গৌড় , সপ্তগ্রাম , চট্টগ্রাম - ইত্যাদি শহরগুলি স্থানীয় বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এছাড়াও এই সময়কালে কৃষির উন্নয়ন সাধিত হয়। এইভাবে ব্যবসা - বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতি - উভয়ের সমৃদ্ধির ফলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। 

১০. ভক্তিবাদের সূচনা ও ভাবজগতে বিপ্লব :- 
বাংলার ভাবজগৎ ও আধাত্মিকতার ক্ষেত্রে হোসেনসাহি যুগ তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুগেই চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটে। শ্রীচৈতন্যদেব প্রেমধর্মের প্রচার করে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। সুলতান হোসেন শাহ ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের মানবধর্ম ও প্রেমধর্ম প্রচারের পরম পৃষ্ঠপোষক। বস্তুতঃ হোসেনসাহি শাসকদের উদার ধর্মীয় নীতির ফলেই বাংলায় ভক্তিবাদের বিশেষ বিস্তার ঘটে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর হোসেন শাহকে ' কৃষ্ণের অবতার ' বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়াও ধর্মীয় উদারনীতি গ্রহণের কারণে হোসেন শাহকে ' বাংলার আকবর ' রূপেও অভিহিত করা হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , হোসেনসাহি রাজত্বকাল প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল যাবৎ যে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ও বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল তার ফলে বাংলার রাজনৈতিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জগতে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়। হোসেনসাহি শাসকেরা ধর্মীয় উদারনীতি গ্রহণ করে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে সহায়ক হয়েছিলেন - এটিই ছিল হোসেনসাহি বংশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান।    


You May Also Like

0 comments