ইলিয়াসশাহি বংশ : বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইলিয়াসশাহি বংশের অবদান।

by - July 12, 2022

ইলিয়াসশাহি বংশ : বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইলিয়াসশাহি বংশের অবদান। 

ইলিয়াসশাহি বংশের রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা কর। 

বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াসশাহি বংশের গুরুত্ব আলোচনা কর।    




বাংলায় ইলিয়াসশাহি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তিনি দিল্লির নিয়ন্ত্রণমুক্ত এক স্বাধীন শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় ইলিয়াসশাহি রাজবংশ দুটি ধারায় রাজত্ব করে - প্রথমটি ছিল ১৩৪২ থেকে ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ এবং দ্বিতীয়টি ছিল ১৪৪২ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ইলিয়াসশাহি রাজবংশের এই দেড়শো বছরের শাসনে বাংলার রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়। বাংলার রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইলিয়াসশাহি শাসনের গুরুত্ব আলোচনা করা হল। 


বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইলিয়াসশাহি শাসনের অবদান ও গুরুত্ব :- 


১. স্বাধীন শাসনের প্রতিষ্ঠা :- 
ইলিয়াসশাহি আমলে বাংলায় এক স্বাধীন শাসনের প্রতিষ্ঠা হয় , যা প্রায় শতাধিক বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই শাসন দিল্লির তুর্কি শাসনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ছিল। এই স্বাধীন সত্তা বজায় ছিল আকবর কর্তৃক বঙ্গদেশ জয় পর্যন্ত। এইভাবে তুর্কি প্রভাবমুক্ত থাকার ফলে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। 

২. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধতা :- 
ইলিয়াসশাহি শাসকেরা বারংবার দিল্লির তুর্কি শাসকদের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখেন। কিন্তু দিল্লির সুলতানের পক্ষে বাংলার এই স্বাধীনতা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তাঁরা বারবার বাংলা আক্রমণ করলেও বাংলা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখে। সমগ্র উত্তর ভারত যখন দিল্লি সুলতানির পদানত হয়েছিল , তখন বাংলার স্বাধীন অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। 

৩. সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ :- 
ইলিয়াসশাহি শাসকেরা বাংলার বাইরেও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেন। বিহার , আসাম , উড়িষ্যা , বারাণসী , গোরক্ষপুর - ইত্যাদি প্রদেশেও ইলিয়াসশাহি বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি , ইলিয়াস শাহের নেতৃত্বে নেপাল জয় করাও সম্ভব হয়েছিল। যদুনাথ সরকার ইলিয়াসশাহি বংশের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে নেপাল জয় কে তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। 

৪. সুষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা : - 
ইলিয়াসশাহি আমলে বাংলায় এক সুষ্ঠ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মুসলিমদের সঙ্গে সঙ্গে যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন অ - মুসলিম প্রজাদেরকেও শাসনকার্যে সুযোগ দেওয়া হত। হিন্দু নায়ক ও সামন্তরা মর্যাদার আসন লাভ করেন এবং তাঁদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বহু হিন্দুকে প্রশাসনের উচ্চপদ প্রদান করা হয়। এপ্রসঙ্গে ইলিয়াস শাহের হিন্দু সেনাপতি সহদেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

৫. পররাষ্ট্রনীতি :- 
বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গেও ইলিয়াসশাহি বংশের রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চিন ও পারস্যতে ইলিয়াসশাহি শাসকেরা দূত পাঠিয়েছিলেন এবং চিনের একাধিক দূত বাংলায় আসেন। চৈনিক দূত মা - হুয়ানের রচনা থেকে ইলিয়াসশাহি বংশের বহু ইতিহাস জানা যায়।

 

বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইলিয়াসশাহি শাসনের অবদান ও গুরুত্ব :- 


১. হিন্দু - মুসলিম ধর্মীয় সমন্বয় :- 
ইলিয়াসশাহি শাসকেরা বাংলায় হিন্দু মুসলিম সমন্বয় ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম যৌথভাবে প্রশাসনিক ও রাজরাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এর ফলে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং হিন্দুরা ইলিয়াসশাহি শাসকদের সহায়ক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন , ইলিয়াস শাহের আমলে ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে হিন্দু জমিদার ও পাইকরা ইলিয়াসশাহের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। 

২. হিন্দুদের মর্যাদা বৃদ্ধি :- 
ইলিয়াসশাহি আমলে প্রশাসনের উচ্চপদে বহু হিন্দুকে নিয়োগ করা হয়। যেমন মুকুন্দ দাস ছিলেন রাজপন্ডিত , অনন্ত সেন ছিলেন রাজচিকিৎসক। ইলিয়াসশাহ নিজ প্রতিভাবলে বহু হিন্দুকে নিজপক্ষে আনতে সমর্থ হন। এর ফলে বাংলায় হিন্দুদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজে পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় সমাজে প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। 

৩. গ্রামাঞ্চলে হিন্দু শাসনের একাধিপত্য :- 
ইলিয়াসশাহি আমলে মুসলিম শাসন মূলত শহরাঞ্চলেই প্রচলিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু জমিদার ও স্থানীয় শাসক বর্গের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। কর আদায় ও শাসন পরিচালনা উভয়ই ছিল হিন্দুদের হস্তগত। 

৪. নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভব :- 
একদিকে শহরাঞ্চলে হিন্দু আমলাতন্ত্র এবং অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন - এই দুইয়ের ফলে বাংলার সমাজে এক নতুন ধরণের হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সামাজিক , আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী ছিলেন। 

৫. ইসলামের প্রসার :- 
ইলিয়াসশাহি শাসনে বাংলার ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক উদার ও সমন্বয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গ্রামবাংলায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হওয়ার ফলে বহু সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের হিন্দুদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে।  

৬. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা :- 
ইলিয়াসশাহি আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষতা লক্ষ্য করা যায়। এই যুগের ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান নিদর্শন হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের হাত ধরেই চর্যাপদ থেকে বাংলা ভাষা রূপান্তরিত হয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াসশাহ , সিকান্দার শাহ ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শন করেন। 

৭. অনুবাদ সাহিত্যের উৎকর্ষতা : - 
অনুবাদ সাহিত্যও ইলিয়াসশাহি শাসনে বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। এই আমলের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অনুবাদ সাহিত্যগুলি হল - কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়। এই সাহিত্যকীর্তিগুলি আজও বাংলা সাহিত্যে সমান গুরুত্বপূর্ণ। 

৮. অন্যান্য সাহিত্য ও সাহিত্যিক :- 
ইলিয়াসশাহি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড় , পাণ্ডুয়া , লক্ষণাবতী - ইত্যাদি শহরগুলি শিল্প ও সংস্কৃতির বিশেষ উৎকর্ষ কেন্দ্রে পরিণত হয়। অমরকোষ গ্রন্থের টীকা রচনা করেন বৃহস্পতি মিশ্র। এই টীকা গ্রন্থটির নাম পদচন্দ্রিকা। মালাধর বসু ' গুণরাজ খাঁ ' ও তাঁর পুত্রকে ' সত্যরাজ খাঁ ' উপাধি দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় , ইলিয়াসশাহি আমলে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় থাকার ফলে সাহিত্যক্ষেত্রে তা বিশেষ সহায়ক হয়। 

৯. স্থাপত্য ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা :- 
ইলিয়াসশাহি শাসনকালে বাংলায় স্থাপত্য শিল্পে বিশেষ উৎকর্ষতা লক্ষ্য করা যায়। এই সময় বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়। যেমন - আদিনা মসজিদ , কোতওয়ালি দরওয়াজা , জামি মসজিদ , লোটন মসজিদ , চামকাটি মসজিদ , তাঁতিপাড়া মসজিদ - ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সকল স্থাপত্যকীর্তিগুলি গঠনরীতি ও শিল্প স্বাতন্ত্রতায় আজও বিশিষ্ট হয়ে আছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল আদিনা মসজিদ। উত্তর - দক্ষিণ ও পূর্ব - পশ্চিমে এর পরিধি ছিল যথাক্রমে ৫০৭ ফুট ও ২৮৫ ফুট। এছাড়াও ইলিয়াস শাহ হাজিপুর শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  

পরিশেষে বলা যায় , একটি স্বাধীন ও স্থায়ী শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্বের ফলে ইলিয়াসশাহি আমলে শিক্ষা , সংস্কৃতি , সমাজ , রাজনীতিও অর্থনীতি - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই পরিবর্তন ও উৎকর্ষতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ধর্মীয় উদারতা ও ধর্ম সমন্বয় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। এছাড়াও দিল্লি তুর্কি শাসকদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইলিয়াসশাহি শাসকেরা যে স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এই স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার ফলেই বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।  

     

You May Also Like

0 comments