গুপ্তযুগের আর্থ - সামাজিক অবস্থার পরিচয় দাও।

by - August 04, 2022

গুপ্তযুগের আর্থ - সামাজিক অবস্থার পরিচয় দাও। 

গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিচয় দাও। 

গুপ্তযুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।  




গুপ্তযুগের আর্থ - সামাজিক অবস্থা :- 

মৌর্য পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সর্বক্ষেত্রেই অরাজকতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু গুপ্ত যুগে রাজনৈতিক ঐক্যের ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং সুদীৰ্ঘদিন ধরে এই স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। বিভিন্ন মুদ্রা , লিপি ও ফা হিয়েনের বিবরণী , বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র - যেমন - যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি , নারদ স্মৃতি , বৃহস্পতি স্মৃতি - ইত্যাদি থেকে গুপ্তযুগের অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কে জানা যায়। 


গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা :- 


১. বহু নগরীর প্রতিষ্ঠা :- গুপ্তযুগে ভারতে বহুসংখ্যক নগরীর প্রতিষ্ঠা সেযুগের অর্থনৈতিক উৎকর্ষতার পরিচয় প্রদান করে। প্রতিটি নগর ছিল সুসজ্জিত এবং প্রতিটি নগর নির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। গুপ্তযুগের নগরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - অযোধ্যা , ইন্দ্রপুর , পাটলিপুত্র ও চন্দ্রপুর। নগরগুলির সাজসজ্জা , পরিকল্পনা , অট্টালিকা , স্থাপত্য নির্মাণ - ইত্যাদি সবকিছুই গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক উৎকর্ষতার প্রমান দেয়। 

২. কৃষিজ উৎপাদন :- গুপ্তযুগের অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। কৃষি জমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল - (ক ) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনাবাদি জমি , (খ ) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আবাদি ও নিয়মিত জমি এবং (গ) ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। তবে তত্ত্বগতভাবে রাজাই ছিলেন জমির প্রকৃত মালিক। রাষ্ট্রের প্রধান ভূমিরাজস্ব আয় হত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আবাদি জমি ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি থেকে। 

৩. শিল্পগত উৎকর্ষতা :- গুপ্তযুগের সাহিত্যে মোট ৬৪ রকমের শিল্পের কথা জানা যায়। দিল্লিতে অবস্থিত লৌহ স্তম্ভটি গুপ্তযুগের লৌহ শিল্পের চরম উৎকর্ষতার পরিচয় প্রদান করে। এছাড়াও রেশমশিল্প ও কার্পাস বয়ন শিল্প ছিল প্রধান। অন্যান্য শিল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - চর্মশিল্প , কাষ্ঠশিল্প , ধাতুশিল্প - ইত্যাদি। 

৪. বণিক সংঘ বা গিল্ড :- গুপ্তযুগের অর্থনীতিতে আধুনিককালের চেম্বার অব কমার্স এর মত বণিক সংঘ বা গিল্ডের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। গিল্ডগুলি একদিকে কারিগর বা উৎপাদক শ্রেণীর এবং অন্যদিকে ক্রেতার স্বার্থরক্ষা করত। এমনকি , এই বণিকসভা স্থানীয় শাসন কার্যেও অংশগ্রহণ করত। এছাড়াও স্থানীয় বণিক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ' পরামর্শক সভা ' গঠিত হত। 

৫. ব্যাংকের অস্তিত্ব :- গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। বৈশালী , কোটিবর্ষ - ইত্যাদি বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে ব্যাংক বিশেষভাবে প্রাধান্যলাভ করেছিল। এই ব্যাঙ্কগুলি পরিচালনা করতেন ব্যবসায়িক নিগমগুলি। ব্যাঙ্কগুলিতে নগদ অর্থ , মূল্যবান সম্পদ , জামানত জমা রাখার ব্যবস্থা ছিল। 

৬. মুদ্রা ব্যবস্থা :- গুপ্তযুগে স্বর্ণ , রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল। গুপ্তযুগে স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। গুপ্তযুগে স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপক প্রচলন সেই যুগের চরম অর্থনৈতিক উৎকর্ষতার পরিচয় বহন করে। 

৭. রাজস্ব ব্যবস্থা :- গুপ্তযুগে বিভিন্ন ধরণের রাজস্ব প্রচলিত ছিল। যেমন - ভাগ বা ভূমিকর , উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ রাজস্ব , শিল্পজাত দ্রব্যের উপর কর - ইত্যাদি। এছাড়াও বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান বা বিষ্টি , ফেরি কর , লবণ কর , বৈদেশিক আক্রমণ ও যুদ্ধের সময় মল্লকর - ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের করের কথা জানা যায়। 

৮. ব্যবসা - বাণিজ্য :- গুপ্তযুগে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয়প্রকার বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। বৈদেশিক ক্ষেত্রে রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে , জাভা , সুমাত্রা , আফগানিস্তান , পারস্য - ইত্যাদি রাষ্ট্রের সঙ্গে গুপ্তদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। মালব , সৌরাষ্ট্র , উজ্জয়িনী , কোঙ্কন উপকূল , ব্রোচ - ইত্যাদি বন্দর দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হত। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নদী ও সড়কপথে বারাণসী , মথুরা , সারনাথ , পাটলিপুত্র , নাসিক , পৈথান - ইত্যাদি অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য চলত। বাণিজ্য থেকে ১/৫ অংশ কর আদায় করা হত। 


গুপ্তযুগের সামাজিক অবস্থা :- 


১. বর্ণপ্রথার প্রাধান্য :- সমাজে ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শুদ্র - এই চারবর্ণের ভেদাভেদ প্রকট হয়ে ওঠে।বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সংমিশ্রণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং বর্ণ সংমিশ্রণ প্রতিরোধ করা ছিল প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অন্যতম কর্তব্য। সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক এবং পরিবারের প্রধান কর্তা ছিলেন পিতা। 

২. সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য :- সমাজে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও অধিকার ছিল সর্বাধিক। ব্রাহ্মণরা 'দ্বিজ' নামে পরিচিত হতেন। বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে ব্রাহ্মণদের পবিত্রতার কথা জানা যায়। ব্রাহ্মণরা পূজা - অর্চনা , বিদ্যা - শিক্ষা , তপস্যা ও বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন। ব্রাহ্মণরা রাজসভাতে নিযুক্ত হতেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজাকে উপদেশ প্রদান করতেন। 

৩. শূদ্রদের অবস্থা :- গুপ্তযুগে শূদ্রদের অবস্থা অন্যান্য যুগের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। ক্রীতদাস ও শূদ্রদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বৈশ্যদের দুর্দশা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় দরিদ্র বৈশ্যদের সঙ্গে শূদ্রদের পার্থক্য কমে এসেছিল। হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছেন কৃষি ক্ষেত্রে শূদ্রদের নিয়োগ করা হত। 

৪. বিবাহ ব্যবস্থা :- গুপ্তযুগে বর্ণভেদ প্রথা কঠোর হলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমাজে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। গুপ্ত রাজবংশে বহুবিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও সামাজিক কর্মকান্ডে কেবলমাত্র প্রধানা মহিষী অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন। সাধারণতঃ স্বজাতির মধ্যে বিবাহ প্রচলিত থাকলেও অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহও প্রচলিত ছিল। 

৫. সমাজে নারীর স্থান :- গুপ্ত সমাজে স্ত্রী - ধনের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমাজে নারীশিক্ষার বহুল প্রচলন ছিল। সমাজে সতীদাহ প্রথা ও বিধবা বিবাহ উভয়ই প্রচলিত ছিল। রাজপরিবার ও অভিজাত পরিবারের নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করতেন। নারীরা স্বাধীন জীবন - যাপন করলেও পুরুষের অনুমতিসাপেক্ষে তারা পারিবারিক ও পরিবারের বাইরের কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করতে পারতেন। 

৬. সঙ্কর জাতির উদ্ভব :- গুপ্তযুগে বহু সঙ্কর জাতির উদ্ভব হয়েছিল। যেমন - বাকাটক বংশের বিভিন্ন উপাদান থেকে জানা যায় , ব্রাহ্মণ পিতা ও ক্ষত্রিয় জননীর পুত্ররা ক্ষত্রিয় বলেই বিবেচিত হতেন। এছাড়াও এক শ্রেণীর ক্ষত্রিয় বিদ্যা - শিক্ষা ও শাস্ত্র চর্চায় অংশগ্রহণ করলে তাঁরা কায়স্থ নামে পরিচিত হন। 

৭. সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ :- গুপ্তযুগে উত্তর - পশ্চিম ভারত থেকে বহু সংখ্যক বিদেশিদের আগমন ঘটে। ফলে সমাজে এক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে এই সকল বিদেশিরা ভারতীয় ধর্ম , ভাষা , রীতিনীতি - ইত্যাদি গ্রহণ করলে ভারতীয় সমাজে এক মিশ্র সংস্কৃতি জন্ম নেয়। এর ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয় , তেমনি অন্যদিকে ব্যবসা - বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। 

৮. দাসপ্রথা :- গুপ্তযুগে দাসত্ব প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। মনু স্মৃতি ও নারদ স্মৃতি থেকে জানা যায় যুদ্ধের সময় স্বেচ্ছায় দাসত্বে পরিণত হওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। প্রধানতঃ যুদ্ধবন্দীদের দাসত্বে পরিণত করা হত। দাসদের কোনো আইনগত অধিকার না থাকলেও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হত। 

৯. অস্পৃশ্যতা :- গুপ্তসমাজে অস্পৃশ্যতা প্রচলিত ছিল। ফা হিয়েনের বিবরণী থেকে জানা যায় - চন্ডালরা বসবাস করতেন মূল নগরের বাইরে। এছাড়াও অন্যান্য অস্পৃশ্য প্রজাতির মানুষ - যেমন - পুলিন্দ , শবর , কিরাত - রা পাহাড় , অরণ্য অঞ্চল , বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্য - ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস করতেন।     


You May Also Like

0 comments