আরবদের সিন্ধু অভিযানের গুরুত্ব ও ফলাফল।

by - August 08, 2022

আরবদের সিন্ধু অভিযানের গুরুত্ব ও ফলাফল।  

ভারত ইতিহাসে আরব আক্রমণের প্রভাব। 



আরবদের সিন্ধু অভিযানের গুরুত্ব ও ফলাফল :- 


ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুল আরবদের সিন্ধু অভিযানকে ভারত ও ইসলামের ইতিহাসে একটি ফলাফলবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। ডক্টর শ্রীবাস্তব আরবদের সিন্ধু অভিযানকে একটি গুরুত্বহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে আরবরা সিন্ধু বিজয় করলেও তাদের সীমানা ছিল সিন্ধু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ; তাই বৃহত্তর ভারতে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কোনো প্রভাব পড়েনি। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর এর শাসনকালে আরবরা সর্বপ্রথম ভারতের পশ্চিম উপকূল ও সিন্ধু এলাকায় আক্রমণ করে। কিন্তু এইসকল সফল হয়নি। অবশেষে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশেমের নেতৃত্বে আরবরা সিন্ধু অভিযানে সফলতা লাভ করে। আরবদের সিন্ধু অভিযানের ফলাফলগুলি নিম্নরূপ - 


১. আরবদের আধিপত্য কেবলমাত্র সিন্ধু প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই কোনোরূপ রাজনৈতিক বা আর্থ -সামাজিক প্রভাব বৃহত্তর ভারতে রেখাপাত করতে পারেনি। এমনকি , আরবরা শাসনপ্রণালীর দিক দিয়েও ভারতের অন্য কোনো অঞ্চলকে প্রভাবিত করতে পারেনি। 

২. আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পর কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সেই এলাকায় ভারতীয় ভাষা , শিল্প , সংস্কৃতি , জীবনযাত্রা - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই আরব শাসনের কোনো প্রভাব পড়েনি। ভারতীয় মৌলিকত্ব সেখানে বজায় ছিল। 

৩. সামাজিক ক্ষেত্রেও আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রভাব ছিল নগন্য বা ছিলনা বললেই চলে। আরবরা সিন্ধু অঞ্চল দখল করলেও তথাকার সামাজিক রীতিনীতির উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। শুধুমাত্র সিন্ধু এলাকায় সামান্য কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক রীতিনীতির উপর আরব আক্রমণের প্রভাব পড়েছিল - যা উল্লেখযোগ্য নয়। 

৪. তবে ব্যবসা - বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরব বিজয়ের প্রভাব পড়েছিল। কেননা , সিন্ধু অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আরব প্রদেশগুলিতে ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আরবদের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে। বিশেষ করে আরব দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে সিন্ধুর বণিকদের সফলতা উল্লেখযোগ্য। 

৫. সিন্ধু এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আরব বাণিজ্যকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। সিন্ধু এলাকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ সিন্ধুর বণিকদের দ্বারা ইউরোপ , দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া ও আরব দেশগুলিতে রপ্তানি হতে থাকে ;ফলে সিন্ধুর বণিকরা সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। ইউরোপ ও আরবের বিভিন্ন শহরে সিন্ধুর বণিকদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়। 

৬. ডক্টর শ্রীবাস্তব অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , আরবদের সিন্ধু অভিযান প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালের তুর্কি অভিযানের ভিত রচনা করে এবং ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। তুর্কিরা আরবদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত না হলেও তা পরোক্ষভাবে তুর্কিদের উৎসাহিত করে। এর পেছনে মূল উপাদান ছিল ভারতের সম্পদ। 

৭. ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতা আরবদের বিস্মিত করে। তাঁরা ভারতীয় শাস্ত্র , হিন্দু দর্শন , চিকিৎসাশাস্ত্র , আয়ুর্বেদশাস্ত্র , গণিত , জ্যোতিষ , সঙ্গীত ও চিত্রকলা - ইত্যাদি বিষয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। আরবদের হাত ধরে এই সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি আরবদেশসমূহ , ইউরোপ ও দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। 

৮. সাহিত্যক্ষেত্রে আরবদের অবদান সামান্য হলেও উল্লেখযোগ্য। ব্রহ্মগুপ্তের ' ব্রহ্মসিধান্ত ' ও ' খন্ড - খাদ্য ' - এই সংস্কৃত গ্রন্থদুটি খলিফা মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি আরব দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়ে। 

৯. ভারত থেকে বহু পন্ডিত , চিত্রশিল্পী , সংগীতজ্ঞ , কারিগর - আরবের রাজসভায় আমন্ত্রিত হন। তাঁদের হাত ধরে ভারতীয় সঙ্গীত , সাহিত্য ও সংস্কৃতি আরব দেশগুলিতে প্রসারের সুযোগলাভ করেছিল। 

১০. আরব ও সিন্ধুপ্রদেশে যে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ তৈরী হয় তার মাধ্যমে আরবের চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বাগদাদের চিকিৎসালয়গুলিতে বহুসংখ্যক ভারতীয় চিকিৎসক নিযুক্ত ছিলেন। 

১১. অধ্যাপক হ্যাভেল মন্তব্য করেছেন - ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের ফলে আরব দেশসমূহ ,ইউরোপ ও দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল। ভারতে ইসলামের সূচনার আদিপর্বে ভারতীয়রাই ছিল প্রকৃত শিক্ষক। সেকারণেই ভারতীয় ইসলাম স্বতন্ত্র ও মৌলিক ধারায় আবর্তিত হয়। 

১২. সিন্ধু বিজয়ের হাত ধরেই আরবীয়রা ভারতীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য সম্পদ আরোহন করে।    


You May Also Like

0 comments