মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন

by - March 06, 2022

মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন


Achievements of Muhammad bin Tughlaq in the history of the Sultanate. ( In Bengali ) 


মহম্মদ বিন তুঘলক - এর রাজত্বকালের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা ও সংস্কারগুলি আলোচনা করো। তাঁকে কি বৈপরীত্যের সংমিশ্রণ বলা যায় ? এ প্রসঙ্গে তোমার অভিমত ব্যাক্ত করো। 


অথবা , মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের প্রধান - প্রধান ঘটনাগুলি উল্লেখ করো। সেগুলি কী কারণে ব্যর্থ হয় ?


অথবা , সুলতানি সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো। 


Evaluate the achievements of Muhammad bin Tughlaq in the history of the Sultanate. ( In Bengali ) 





মহম্মদ  বিন তুঘলক 1325 -1351 সংস্কার ও কৃতিত্ব:-


আলাউদ্দিন খলজির নরপতিত্বের আদর্শের সার্থক অনুসরণকারী ছিলেন মহম্মদ বিন তুঘলক। ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে আলাউদ্দিনের আদর্শ এক মহান আদর্শের ইঙ্গিত দেখায়। সেই আদর্শ ভারতে রাজতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করতে এবং উলেমা , অভিজাত্যের ক্ষমতা নস্যাৎ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।  ধর্ম ও শ্রেণী বিশেষের আধিপত্য ও প্রভাব থেকে রাজতন্ত্র তথা রাষ্ট্রকে মুক্ত রেখে এক নতুন আদর্শের অবতারণা আলাউদ্দিন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন করতে মহম্মদ বিন তুঘলক প্রয়াসী হন।
আর পি ত্রিপাঠীর মতে , ''মহম্মদ বিন তুঘলক ধর্ম বিষয়ে আইন-কানুন অগ্রাহ্য করে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে রাজতন্ত্র কে শক্তিশালী করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।''

তবে আলাউদ্দিন খলজির নরপতিত্বের আদর্শের মত মহম্মদ বিন তুঘলকের আদর্শ প্রয়োজনভিত্তিক ছিল না। তা ছিল যুক্তিবাদ সম্মত। মহম্মদ বিন তুঘলকের নরপতিত্বের আদর্শ - এর মূল লক্ষ্য ছিল প্রজাবর্গের মঙ্গল সাধন।  তিনি রাষ্ট্রকে নিপীড়ন যন্ত্রের পরিবর্তে মানবহিতৈষী সংস্থা হিসেবে গণ্য করতেন। মহম্মদ বিন তুঘলকের অভিপ্রায় ছিল উলেমা ও অভিজাতরা  রাষ্ট্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিবর্তে নিজের কর্তব্য পালন করবেন। একথা সত্য নয় যে তিনি উলেমা ও অভিজাতদের প্রতি অহেতুক কঠোর ছিলেন।  ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায় যে , উলেমা অভিজাতদের অনেকেই সুলতানের বদান্যতা ও দয়া-দাক্ষিণ্য লাভ করেছিলেন। সিংহাসনে উপবিষ্ট তিনি মুসলমান প্রজাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে খলিফার আশীর্বাদ অনুমোদন লাভেরও চেষ্টা করেন নি। এক কথায় তিনি সকল ধর্মের প্রভাব থেকে রাজতন্ত্রকে বিযুক্ত রাখবার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সুলতানি সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করলে মহম্মদ বিন তুঘলক কে আমরা ব্যতিক্রমী চরিত্র রূপে দেখতে পাই। তার আমলে বহুবিধ পরিকল্পনা ও সংস্কার যেগুলি সম্পর্কে বহুবিধ সমালোচনা বর্তমান - তার চরিত্রকে এক ব্যতিক্রমী রূপ দেয়। তার রাজত্বের বিভিন্ন সংস্কারগুলি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো। 


রাজস্ব সংস্কার :- 
ক্ষমতায় উপবিষ্ট হয়ে মহম্মদ বিন তুঘলক রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে বিবিধ সংস্কার প্রবর্তন করেন। তিনি রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করেন। রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করার জন্য দোয়াব অঞ্চলে করের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন। সম্ভবত ভূমিকর বৃদ্ধি করার পরিবর্তে অন্যান্য কর শতকরা 5 থেকে 10 গুণ বৃদ্ধি করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সুলতানের রাজকর্মচারীদের উৎপীড়নের ফলে গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কৃষকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। এই অবস্থায় সুলতান প্রচুর ঋণদান ও জল সেচের ব্যবস্থা করে কৃষকদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে অর্থের অপব্যবহার হয় , কর অনাদায়ী থাকে এবং সুলতানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। 

এছাড়াও কৃষির উন্নতি কল্পে তিনি '' আমীরে - কোহী '' নামে একটি নতুন কৃষি  বিভাগ স্থাপন করেন। সরকারি ব্যয়ে পতিত জমিকে কৃষি উপযোগী করে তোলাই এ বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল। এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে দু'বছরে প্রায় 70 লক্ষ টাকা ব্যয় হয় এবং বহু কর্মচারী নিযুক্ত হয়। কিন্তু অবশেষে এই পরিকল্পনাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিফলতার কারণ হলো - 
প্রথমত :-যেসকল জমি এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তার অধিকাংশ ছিল চাষের অনুপযোগী। 

দ্বিতীয়তঃ এ পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এবং এর সাফল্যের জন্য সুলতানের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানের  একান্ত প্রয়োজন ছিল। 

তৃতীয়তঃ সুলতান নিজে তত্ত্বাবধান করতে না পারায় অধিকাংশ অর্থের অপচয় ঘটে। 


রাজধানী স্থানান্তর :- 
মহম্মদ বিন তুঘলকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিকল্পনা হলো দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর। একাধিক কারণে সুলতান এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। 

প্রথমতঃ  সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় স্থানে রাজধানী স্থাপন করা। 
দ্বিতীয়ত দিল্লি উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় সর্বদাই মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা থাকতো। সুতরাং দূরবর্তী দেবগিরি এই বিষয়ে অধিকতর নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। 
তৃতীয়তঃ দেবগিরি থেকে দক্ষিণ ভারতের সুলতানি শাসন পরিচালনা করা বেশি সহজ ছিল। 
চতুর্থতঃ  ইবন বতুতার মতে দিল্লির নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিরক্ত হয়ে সুলতান রাজধানী স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। 

সুলতানের আদেশে দিল্লির সমস্ত অধিবাসীসহ রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন রাজধানীর নাম হয় দৌলতাবাদ। যাত্রীদের জন্য পথে ছায়া বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং সেখানে সরাইখানা নির্মাণ করা হয়। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে দূরত্ব ছিল 1500 কিমি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জনগণের শারীরিক ক্লেশ ও দুর্দশার সীমা ছিল না। দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য মানুষ কাতর হয়ে ওঠে। একথা সত্য যে শুধুমাত্র রাজধানী স্থানান্তরিত করে সন্তুষ্ট থাকলে হয়তো এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হতো না কিন্তু সুলতান সেইসঙ্গে দিল্লির নাগরিকদেরও স্থানান্তরিত করে মারাত্মক ভুল করেছিলেন। এরপর কিছুদিনের মধ্যে সুলতান নিজ ভ্রম বুঝতে পেরে পুনরায় দৌলতাবাদ থেকে সকলকে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। পুনরায় যাত্রা শুরু হয় এবং সুদীর্ঘ পথ পর্যটনের ক্লেশ সহ্য করতে না পেরে বহুলোক পথিমধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং যারা জীবিতাবস্থায় দিল্লিতে ফিরেছিল তাদের দুঃখ কষ্টের সীমা ছিল না। দিল্লির পূর্ব গৌরব ফিরে আসতে বহু সময় লাগে এবং দৌলতাবাদ জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়। 
লেনপুল এর ভাষায় ‘’ Daulahatabad remained a monument of misdirected energy.’’ 

তবে পরিকল্পনা নেই ব্যর্থ হলেও দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের  ফলে কয়েকটি ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। যেমন - দক্ষিণ ভারত ও উত্তর ভারতের মধ্যে যোগসূত্র রচিত হয়। দক্ষিণ ভারতে তুর্কি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উত্তর ভারতের প্রসার লাভ করে।  এছাড়া রাজনৈতিক দিক থেকে দেবগিরিতে প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন দক্ষিণ ভারতের রাজনীতির পক্ষে ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল। 


মুদ্রা সংস্কার ও প্রতীকী তাম্রমুদ্রার প্রচলন :-
মুদ্রানীতির সংস্কার ছিল মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের অপর এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মূল্যবান ধাতুর পরিবর্তিত মূল্য অনুসারে তিনি নতুন মুদ্রার প্রবর্তন করেন। ''দোকানি'' নামে এক নতুন মুদ্রা প্রচলন করা হয়। '' দিনার '' নামে এক নতুন স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করা হয় এবং ইবন বতুতার মতে এর ওজন ছিল দুইশত গ্রেন বা রতি।  এছাড়া 140 রতি ওজনের এক নতুন রৌপ্যমুদ্রার ( টঙ্কা ) প্রচলন করা হয়। 

কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা হলো প্রতীকী তাম্র মুদ্রা প্রবর্তন। এই প্রতীকী তাম্রমুদ্রার প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কে সমসাময়িক ও আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।  বারণির মতে , সুলতানের অপরিমিত দানশীলতার ফলে রাজকোষে মুদ্রার অনটন দেখা দেয় এবং বিশ্বজয় পরিকল্পনা সার্থক করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এই কারণে তিনি তাম্র মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। তাছাড়া রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তরিত করার ফলে রাজকোষের অপরিমিত ক্ষতিপূরণের জন্য তাম্র মুদ্রার প্রচলন করা হয়। 
কিন্তু জাল মুদ্রার অবাধ প্রচলনের ফলে মুদ্রার মূল্য হ্রাস পায়। বিদেশি বণিকরা তাম্রমুদ্রা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। প্রতীকী তাম্রমুদ্রা প্রবর্তনের 4 বছরের মধ্যে সুলতান এই পরিকল্পনার ব্যর্থতা উপলব্ধি  করে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে তাম্রমুদ্রা প্রত্যাহার করে নেন।  সুতরাং সুলতান জনগণকে প্রতারণা করেছিলেন এমন অভিযোগ যথার্থ নয়। 

মহম্মদ বিন তুঘলকের বিদেশনীতি :  খোরাসান জয়ের পরিকল্পনা :- 
ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই মহম্মদ বিন তুঘলক খোরাসান ও ইরাক জয় করতে উদ্যোগী হন। সম্ভবতঃ কয়েকজন খোরাসানী বিদ্রোহীদের প্ররোচনায় তিনি এই পরিকল্পনায় প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। এই উপলক্ষে প্রায় 3 লক্ষ 70 হাজার সেনা সংগৃহীত হয় এবং এক বছর ধরে তাদের পোষণ করা হয়। অবশেষে হিন্দুকুশ এর দুর্গম গিরিপর্বতের মধ্যে দিয়ে সুদূর মধ্য-এশিয়া অভিযান অসম্ভব উপলব্ধি করে সুলতান এই সংকল্প ত্যাগ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বারণি লিখেছেন - ‘’ The coveted countries were not acquired and his treasure was expended ‘’.


মহম্মদ বিন তুঘলকের সাফল্য ও কৃতিত্বের পর্যালোচনা :-


মহম্মদ বিন তুঘলকের সাফল্য ও কৃতিত্ব বিচারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। মহম্মদ বিন তুঘলকের সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবন বতুতা ও বারণি তার সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেছেন। বারণি সুলতানকে রক্তপিপাসু ও বর্বর বলে প্রতিপন্ন করেছেন। কিন্তু ইবন বতুতা তার প্রতি এরূপ কোন অভিযোগ করেননি।  বরং তিনি তাকে বিনয়ী , সত্যনিষ্ঠ ও উদার প্রকৃতির নরপতি বলে বর্ণনা করেছেন। 

অপরদিকে এলফিনস্টোন , স্মিথ , হ্যাভেল , এডওয়ার্ড , টমাস প্রমুখ  আধুনিক ঐতিহাসিকরা তাঁকে উন্মাদ ও বিকৃতমস্তিস্ক বলে সমালোচনা করেছেন। পক্ষান্তরে , গার্ডনার ব্রাউনের বর্ণনায় সুলতানের বিকৃত মস্তিষ্ক ও রক্তপিপাসু অভিযোগ পাওয়া যায় না। 

একথা সত্য যে মহম্মদ বিন তুঘলক কখনো কখনো সামান্য অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি দান করতেন এবং এর কারণ হলো তিনি নিজে অপরাধের তারতম্য করতে পারতেন না। মধ্যযুগের ইউরোপ ও এশিয়ায় প্রাণদণ্ড অতিসাধারণ দন্ড হিসেবে বিবেচিত হতো। মহম্মদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো তিনি ছিলেন কল্পনাপ্রবন।  একথা অনস্বীকার্য তিনি ছিলেন খামখেয়ালি প্রকৃতির ; নতুনত্বের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। কিন্তু তিনি যে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন সেগুলির মধ্যে সৃষ্টিশীল প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।  যেমন তার রাজস্ব ও মুদ্রানীতি সংক্রান্ত সংস্কার। কিন্তু তার পরিকল্পনাগুলি যুগোপযোগী ছিল না বলে  ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 

বিদ্যা , মানসিক উৎকর্ষ ও প্রতিভার দিক দিয়ে বিচার করলে মহম্মদ বিন তুঘলককে  মধ্যযুগের ভারতীয় নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বললে অত্যুক্তি হবেনা। তার পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত ছিল। একাধারে তিনি ছিলেন দার্শনিক , বৈজ্ঞানিক ও গণিত শাস্ত্রবিদ ,  জ্যোতির্বিদ্যা ও ফার্সি ভাষার উপর তাঁর  অসামান্য পান্ডিত্য ছিল। ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অপরিসীম। 

মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা গুলির ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কিছু বিশেষ কারণ ছিল। যেমন :- 
প্রথমত - বদাউনির ভাষায় - ‘’ The king was freed from his people and they from the king’’.
কিন্তু , ঐতিহাসিক লেনপুল লিখেছেন যে , " সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামঞ্জস্যের অভাবে মহম্মদ বিন তুঘলক ব্যর্থ হন। ''  একথা সত্য যে মহম্মদ বিন তুঘলকের বহুমুখী প্রতিভা ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় গ্রহণের ক্ষমতার অভাব ছিলনা ; কিন্তু ব্যবহারিক বুদ্ধির অভাবে তাঁর পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 

দ্বিতীয়তঃ - রাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনার মধ্যে তার বাস্তব বুদ্ধির অভাব দেখা যায়। রাজধানী স্থানান্তর করা ইতিহাসে কোন নতুন বিষয় নয় কিন্তু  সুলতান দিল্লির অধিবাসীদের স্থানান্তরিত করতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করেছিলেন। 

তৃতীয়তঃ - খোরাসান জয়ের পরিকল্পনায় অযৌক্তিক কিছু ছিল না।  কিন্তু সমগ্র দেশ যখন অশান্তি ও বিদ্রোহে নিমজ্জিত - সেসময়ে এ  ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা মোটেই সময়োপযোগী হয়নি। 

চতুর্থতঃ - তার পরিকল্পনা গুলির মধ্যে মৌলিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু সেগুলি যুগোপযোগী ছিল না বলেই কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। এই কারনেই তার তামার নোট প্রচলন প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি। 

পঞ্চমতঃ - রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে উলামাদের প্রতিপত্তি খর্ব করে  সুলতান উলেমাদের  বিরোধিতা ও বিদ্বেষ অর্জন করেছিলেন। তার পরিকল্পনার ব্যর্থতার জন্য শাসকগোষ্ঠীর এই দুই প্রভাবশালী অংশের বিরোধিতা অনেকাংশে দায়ী। 

ষষ্ঠত -  সুলতানের অন্তর্দৃষ্টি , ধৈর্যশীলতা ও সাধারণ বিচার-বিবেচনার অভাব এবং সংস্কারকাজে অস্থিরতা তার বিফলতা অনিবার্য করে তুলেছিল। 

সপ্তমতঃ -  রাজকর্মচারীদের কাছ থেকেও তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা লাভ করেননি। সেই কারণেই তার রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কারগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 

একথা সন্দেহাতীত যে তার 26 বছরে রাজত্বকাল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। 
১. মহম্মদ বিন তুঘলকের বিফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের মর্যাদাহানি হয়। 
২. একাধিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের রাজকোষ প্রায় শুন্য হয়ে পড়েছিল। 
৩. দারুন অর্থাভাব হেতু সাম্রাজ্যের শাসনযন্ত্র একেবারে ভেঙে পড়েছিল। 
৪. শাসনকার্যে দক্ষতা বিনষ্ট হওয়ায় সাম্রাজ্যের সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। 
৫. অশান্তির মধ্যে দাক্ষিণাত্য স্বাধীন হয়ে যায়। বাংলাদেশ  সুলতানি সাম্রাজ্যের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। সিন্ধু দেশ স্বাধীন হয়ে যায় এবং সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলগুলিতে বারংবার বিদ্রোহ শুরু হয়। 
৬.  মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে রাজ্যের সংহতি ও স্থায়িত্ব অনেকাংশে শিথিল করে তুলেছিল। 

এইভাবে নিজের অজান্তে মহম্মদ বিন তুঘলক সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন। তবে সুলতানি সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মহম্মদ বিন তুঘলক এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসাবে সর্বদাই পরিচিত হয়ে থাকবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব না উল্লেখ করলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যেমন নিরপেক্ষ  বিচার ব্যবস্থা স্থাপন , ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা স্থাপন , কৃষির উন্নতিসাধন - প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা মধ্যযুগীয় শাসকদের মধ্যে এক কৃতিত্বের দাবিদার। 


You May Also Like

0 comments