মধ্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো।

by - March 06, 2022

মধ্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো। 

Discuss the features of Mesolithic Age . ( In Bengali ) 




মধ্য প্রস্তর যুগ ও তার বৈশিষ্টসমূহ :-


সুদূর অতীত থেকে শুরু করে ইতিহাসের লিখিত উপাদানের প্রাপ্তি কালের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলা হয়। মানুষ প্রথম থেকে বিভিন্ন ধরণের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে খাদ্যের সংস্থান করত। তাই এই যুগকে প্রস্তর যুগ বলা হয়। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পাথরে নির্মিত হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করে প্রস্তর যুগ কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা - (১) প্রাচীন প্রস্তর যুগ (২) মধ্য প্রস্তর যুগ ও (৩) নব্য প্রস্তর যুগ। নব্য প্রস্তর যুগের শেষে মানুষ ধাতুর ব্যবহার শুরু করে। তারা সর্বপ্রথম তামা এবং এর কিছুকাল পর ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার শেখে। তাই নব্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী সময় কাল হলো তাম্র প্রস্তর যুগ। 


প্রেক্ষাপট ও সময়কাল :-
হেলোসিন যুগের শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে এবং এখনো এই যুগ চলছে। এ যুগের প্রথমদিকে কোনো লিপির আবিষ্কার হয় নি। ফলে এসময়ের ইতিহাস জানার জন্য জীবাশ্ম , সেসময়কার মানুষের গুহাচিত্র , হাতিয়ার , ব্যবহার্য সামগ্রী প্রভৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়। প্লেইস্টোসিন যুগের শেষদিকে চতুর্থ অর্থাৎ সর্বশেষ বরফের যুগের অবসানের পর ভূপ্রকৃতিতে বড়ো ধরণের পরিবর্তন আসে। এসময় বরফের আস্তরণ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ইউরোপের তুন্দ্রা অঞ্চল বনভূমিতে ছেয়ে যায়। নিকট প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ মাঠঘাটগুলি মরুভূমিতে পরিণত হয়। নতুন এই আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পেরে এ যুগে বেশ কিছু প্রাণী ও কিছু কিছু মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। বেঁচে থাকা মানব প্রজাতিগুলি এই সময় নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। 

খাদ্যসংগ্রহকারী প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং খাদ্য উৎপাদনকারী নব্য প্রস্তর যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল মধ্য প্রস্তর যুগ নামে চিহ্নিত হয়। এ যুগের সময়সীমা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে , খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ অব্দ পর্যন্ত মধ্য প্রস্তর যুগ বিস্তৃত ছিল। 


জীবিকা :- 
অন্ত পুরা পাথর পর্বের জীবিকা এসময়ও বজায় ছিল। অর্থাৎ মানুষ খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকার করেই জীবিকা চালাত। তবে এই পর্বে পশুশিকারের তুলনায় বিভিন্ন ধরণের ফলমূল , শামুক , ঝিনুক , মধু - প্রভৃতি সংগ্রহের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়। পশু শিকার অপেক্ষা মৎস শিকারের প্রতি অধিক আগ্রহ দেখা দেয়। আসলে এর জন্য বহুবিধ কারণ দায়ী ছিল। যেমন 

প্রথমতঃ - যুগে নীল , টাইগ্রিস - ইউফ্রেটিস , সিন্ধু , হোয়াং - হো - প্রভৃতি নদীতে বার্ষিক প্লাবন দেখা দেয়। মরু অঞ্চলের কিছু কিছু অংশে উর্বর জমির সৃষ্টি হয়। 

দ্বিতীয়তঃ - অপর দিকে প্লেইস্টোসিন পর্বে লোমশ হাতি , লোমশ গন্ডার প্রভৃতি প্রাণী শীতল আবহাওয়ায় অবলুপ্ত হয়। 

তৃতীয়তঃ - বল্গা হরিণের দল ক্রমশ পশ্চিম ইউরোপ থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে সরে যায়। 
চতুর্থতঃ - সর্বোপরি জলাভূমি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ তার খাদ্য তালিকায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ , শামুক , ঝিনুক প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করে।       

তবে এযুগের মানুষ যে বড় প্রাণী একেবারেই শিকার করতো না - এমনটা কিন্তু নয়। কিছু সহজলভ্য বড় প্রাণী শিকারের পাশাপাশি তারা লাল হরিণ , বনবিড়াল , নেউল - প্রভৃতি পশুও শিকার করতো। এ যুগের মানুষ কোনো কোনো পশুকে পোষ মানাতেও শিখেছিল। এ যুগের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অর্ধ যাযাবর প্রকৃতির। 

হাতিয়ার :- 
এই যুগের মানুষ হাতিয়ার তৈরিতে আরও দক্ষতার পরিচয় দেয়। এই যুগের হাতিয়ারগুলি পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে উন্নত ও আকারে ক্ষুদ্র হয়। এ যুগের মানুষের প্রধান হাতিয়ারগুলো ছিল তিরধনুক , ব্লেড , হারপুন , বড়শি - প্রভৃতি। ছোট পাথর দিয়ে হাতিয়ার তৈরির এই সংস্কৃতি '' মাইক্রোলিথ '' নামে পরিচিত। যেহেতু এই যুগে হাতিয়ারগুলি ক্ষুদ্র আকারে তৈরী হত সেজন্য এই যুগকে '' ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগ '' ও বলা হয়। 
 
পাথর ছাড়া অন্য উপাদানে হাতিয়ার ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরী - মধ্য প্রস্তর যুগের অপর এক অন্যতম বৈশিষ্ট। বিশেষতঃ এই যুগে শিঙের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। শিঙ বা হাড় জলে ভিজিয়ে নরম করে তা কেটে ছুরি , তিরের ফলা ইত্যাদি তৈরী করা হত। হাড় ও কাঠের হাতল লাগিয়ে চাকু , করাত , কাস্তে , বর্শা তৈরী হত। 


পশুপালন :-
মধ্য প্রস্তর যুগের কোনো এক সময় মানুষ পশুপালন করতে শেখে। মানুষের উদ্বৃত্ত খেতে কুকুর মানুষের বাসস্থানের পাশাপাশি বসবাস করতে থাকায় কুকুর হয় মানুষের প্রথম গৃহপালিত পশু। বসতি এলাকা পাহারা দিতে এবং শিকারের জন্য কুকুরের প্রয়োজন হয়েছিল। এছাড়া এই পর্বে মানুষ গরু , ছাগল , মহিষ , শুকর , বিড়াল - প্রভৃতি পশুকে পোষ মানিয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্য প্রস্তর যুগের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে , সেখানে গৃহপালিত পশুর অস্থি - একথাই প্রমান করে। 

সমাজবদ্ধতা :-
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ শিকারের প্রয়োজনে যাযাবর জীবন বেছে নিয়েছিল। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল অর্ধ যাযাবর। এই পর্বে মানুষ পশুশিকার ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য জোটবদ্ধ হয়। তা ছাড়াও বন্য পশুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তো তারা বহু পূর্বেই জোটবদ্ধ হয়েছিল। 

যানবাহন :-
মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষ যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোনো যানবাহন তৈরী করেছিল কি'না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ চাকা মধ্য প্রস্তর যুগে আবিষ্কৃত হয়নি। তবে মনে করা হয় মধ্য প্রস্তর যুগের আদিম মানুষ স্লেজগাড়ির ব্যবহার জানতো। এই গাড়ি টানার জন্য তারা কুকুরকে কাজে লাগতো। তারা জলপথে যাতায়াতের উদ্দেশ্যে গাছের গুড়ি খোদাই করে নৌকা তৈরী করতো। 

চিত্রকলা :-
মধ্য প্রস্তর যুগের চিত্রকলাতে আদিম মানুষ বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এই পর্বে আদিম মানুষ পাথরের ওপর মূর্তি খোদাই করার কাজ শুরু করেছিল। এ ছাড়া মাটির মূর্তি নির্মাণ করার প্রয়াসও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। নিত্যদিনের ব্যবহার্য সামগ্রী এবং বিভিন্ন হাতিয়ার ছিল এ যুগের চিত্রকলার বিষয়বস্তু। মানুষ ও পশুর চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি এই পর্বে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার অঙ্কনের চেষ্টা শুরু করা হয়। ত্রিকোণ , চতুস্কোন , বৃত্তাকার চিত্র - এই পর্বের মানুষেরা আকঁতে শুরু করে। 

অস্তিত্বের নিদর্শন :-
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষের বসবাসের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারতবর্ষে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা , মহারাষ্ট্রের নেভামা , রাজস্থানের দিদওয়ালা এবং উত্তরপ্রদেশ , পাঞ্জাব ও গুজরাটের বিভিন্ন জায়গায় মধ্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতের বাইরে সুইডেন , ফিনল্যান্ড , রাশিয়া এবং শ্রীলঙ্কার কিছু কিছু অঞ্চলে মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে। 

সুতরাং দেখা যায় যে , মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির সময়কাল ছিল স্বল্প কিন্তু সংস্কৃতির পরিবর্তন ছিল তাৎপর্যবহ। প্রস্তর যুগ থেকে সভ্যতার পথে অগ্রসর হওয়ার এই পর্বকে সভ্যতার ঊষালগ্ন 
( Down of Civilisation ) বলা যায়। মধ্য প্রস্তর যুগের বিবর্তন ব্যাতিরকে পরবর্তী নব্য প্রস্তর যুগ সম্পর্কে অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য।    


You May Also Like

0 comments