ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ; Deccan policy of Aurangzeb.

by - December 22, 2021

Describe the Deccan policy of Aurangzeb.

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির বর্ণনা দাও। 

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির সমালোচনাসহ মূল্যায়ন। 

ঔরঙ্গজেব ও মারাঠাদের সম্পর্ক আলোচনা কর। 


ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি :- 


দাক্ষিণাত্যে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা তথা হিন্দু শক্তির উত্থান ঘটলে তা ঔরঙ্গজেবের নিকট বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ঔরঙ্গজেব যখন উত্তর ভারতে ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন , সেই সময়ে শিবাজী নিজের ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি করেছিলেন। তাই ঔরঙ্গজেব যেকোনো মূল্যে মারাঠাদের শক্তির প্রসার রোধ করতে চেয়েছিলেন। 


শিবাজীর বিরুদ্ধে শায়েস্তা খাঁ :- মোগল সিংহাসন অধিকারের পর ঔরঙ্গজেব শায়েস্তা খাঁ'কে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। শায়েস্তা খাঁ শিবাজীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করেন। এরপর শায়েস্তা খাঁ পুনায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। কিন্তু সেই সৈন্য শিবিরে শিবাজী অতর্কিত আক্রমণ করে শায়েস্তা খাঁ'কে পর্যুদস্ত করেন এবং শায়েস্তা খাঁ দাক্ষিণাত্য থেকে পলায়ন করেন। 

শিবাজীর বিরুদ্ধে জয় সিংহ :- এরপর শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরিত হন জয় সিংহ। তিনি কৌশলে শিবাজীকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে পুরন্দরের সন্ধি সাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এইসময় শিবাজীকে মোগল দরবারে নজরবন্দি করে রাখা হলেও তিনি কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করতে সমর্থ হন। 

মোগল - মারাঠা সংঘর্ষ ১৬৭০ :- এরপর ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ এবং তার পর থেকে মোগল ও মারাঠা সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয়। শিবাজী একের পর এক মোগল দুর্গগুলি অধিকার করতে থাকেন। বিশেষ করে মোগলদের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোঙ্কন , মাদুরাই ও পুরন্দরের দুর্গগুলি দখল করলে মোগল বাহিনী অনেকটাই হীনবল হয়ে পড়ে। 


শম্ভূজী ও মোগল দ্বন্দ্ব :- শিবাজীর পর তাঁর পুত্র শম্ভূজী মারাঠা সিংহাসন অধিকার করেন। সিংহাসনে বসেই তিনি মোগল অধিকৃত ঔরঙ্গাবাদ ও বারহানপুর আক্রমণ করেন। এছাড়াও তিনি ঔরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে আশ্রয় প্রদান করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শম্ভূজী যুবরাজ আকবরকে দরবারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মোগল পরিবারের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে অসম্মত হন। ইতিমধ্যেই গোলকোন্ডা ও বিজাপুর মোগলদের হস্তগত হয়েছিল। এরপর ঔরঙ্গজেব এক অতর্কিত আক্রমণে শম্ভূজীকে পরাজিত ও নিহত করেন।     

গোলকোন্ডা ও বিজাপুরে ঔরঙ্গজেবের ভুল নীতি :- শম্ভূজীর মৃত্যুর পর মারাঠারা উদভ্রান্ত হয়ে মোগল অঞ্চলগুলিতে আক্রমণ ও লুঠতরাজ চালাতে থাকে। শম্ভূজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজারাম সিংহাসনে বসেন এবং তিনিও জিন্জিয়া - তে আশ্রয় নিয়ে ব্যাপকভাবে মোগল বিরোধিতা করতে থাকেন। এই বিরোধিতা এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে তা পূর্বঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে। 

কর্নাটকে ঔরঙ্গজেবের ভুল নীতি :- শম্ভূজীর মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেব ধরেই নিয়েছিলেন যে মারাঠা শক্তির অবক্ষয় সপূর্ণ হয়েছে। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি কর্ণাটক অধিকার করতে অগ্রসর হন। কিন্তু বিজাপুর ও গোলকোন্ডার জন্য তিনি কোনো নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করেন নি। 

রাজারামের নেতৃত্বে তীব্র মোগল বিরোধী সংগ্রাম :- ১৬৯০ থেকে ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজারামের নেতৃত্বে মোগল বিরোধী সংগ্রাম ব্যাপক আকার ধারণ করে ও মোগলদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। রাজারামের নেতৃত্বে বেশ কিছু মোগল দুর্গ মারাঠাদের হস্তগত হয়। 

ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত সামরিক নীতি :- ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে শুধুমাত্র সামরিক বিজয় লাভেই মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু মোগলদের সামনে আরো যেসকল সমস্যাগুলি ছিল সেগুলি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা মোগল মারাঠা দ্বন্দ্বের কোনো নির্দিষ্ট ফলপ্রাপ্তি না ঘটায় মোগল সেনাপতি , অভিজাতদের মধ্যে ক্ষোভ আত্মপ্রকাশ পেতে থাকে। আবার বন্যা ও মহামারীতেও মোগল বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। 

মোগল সেনাপতিদের মনোবলে ভাঙন :- এই পরিস্থিতিতে বহু মোগল সেনাপতি ও অভিজাতরা সম্রাটের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে মারাঠাদের সঙ্গে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয় ও নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। তারা মারাঠাদের '' চৌথ '' প্রদান করতে সম্মত হয়। 

শাহু ও মোগল সম্পর্ক :- পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঔরঙ্গজেব শম্ভূজীর পুত্র শাহু ও তার মাতাকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। শাহুকে সাত হাজারি মনসব দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে ১৭০৯ পর্যন্ত রাজারাম মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী তারাবাঈ মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। 


ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির মূল্যায়ন :- 

ঔরঙ্গজেব সারা জীবন ধরে যুদ্ধ করেও মারাঠা বাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করতে পারেননি। তাই ঐতিহাসিকেরা ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিভিন্ন দিক দিয়ে তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতির সমালোচনা করা হয়। যেমন - 
১. মোগল সাম্রাজ্য আকারে বৃহৎ হওয়ায় ঔরঙ্গজেবের পক্ষে শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। 
২. দীর্ঘকাল ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় একদিকে যেমন রাজকোষের ব্যপক ক্ষতি হয়েছিল , তেমন অন্যদিকে মারাঠাদের মোগলভীতি দূর হয়েছিল। 
৩. ঔরঙ্গজেব অত্যন্ত ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা দখল করেছিলেন। ফলে ওই দুই রাজ্যের সৈনিকদের বড় অংশ মারাঠা বাহিনীতে যোগদান করে মারাঠাদের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। 
৪. দীর্ঘকাল ধরে দাক্ষিণাত্য নিয়ে বাস্ত থাকায় সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল ও শিথিল হয়ে পড়েছিল। 
৫. ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে সিয়া রাজ্যগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে তাদের মারাঠাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই কূটনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাতে পারেননি। 
৬. মারাঠাদের ঐক্য , দেশপ্রেম , জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে ঔরঙ্গজেব কোনো ধারণা করতে পারেননি।

পরিশেষে বলা যায় , ঔরঙ্গজেবের পূর্বসূরীরা যে সামরিক নীতি গ্রহণ করছিলেন ঔরঙ্গজেব তা অনুসরণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু মারাঠাদের দুর্দমনীয় মানসিকতার জন্য মোগল বাহিনী কখনোই সম্পূর্ণভাবে তাদের পরাস্ত করতে পারেনি। কিছু ভুল কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত , সংস্কার বিমুখতা , সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্যবোধের অভাব - ইত্যাদি ধীরে ধীরে মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে সুনিশ্চিত করে। 


  

You May Also Like

0 comments