মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট ; features / characteristics of the Feudalism in Medieval Europe.

by - December 22, 2021

Discuss the features / characteristics of the Feudalism in Medieval Europe.

মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো। 

মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট :- 


মধ্যযুগের ইউরোপে কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর বিকাশ ঘটেছিল। সামন্ততন্ত্রের মূল বক্তব্য ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। একটি বৃহৎ ভূখন্ডে রাজত্বকারী কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে রাষ্ট্রের সর্বত্র শাসন ও বিচার পরিচালনা , রাজস্ব আদায় , যুদ্ধ ও সৈন্য পরিচালনা - ইত্যাদি সম্ভব ছিল না। ফলে কেন্দ্রীয় শক্তি আঞ্চলিক স্তরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় ভূস্বামীদের হাতে স্থানীয় স্তরে শাসন পরিচালনা ও সৈন্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশের দুটি পৃথক সময়কাল লক্ষ্য করা যায় - ১. প্রথম সামন্ততন্ত্রের যুগ যা খ্রিস্টীয় নবম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এবং ২. দ্বিতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগ যা খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত। নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালকে সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ ( Classical age of feudalism ) বলা হয়। মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্টগুলি হল - 


১. কৃষি প্রধান অর্থনীতি :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনীতি ছিল মূলতঃ কৃষি নির্ভর। যেহেতু সামন্ততন্ত্র ছিল গ্রামকেন্দ্রিক সেহেতু গ্রামীণ কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই জাতীয় অর্থনীতিতে মুদ্রার বিনিময়ের সেরকম কোনো ভূমিকা ছিল না। 

২. ভূস্বামী প্রধান শাসন ব্যবস্থা :- সামন্ততন্ত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে তা স্থানীয় ভূস্বামীদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। তাই স্থানীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভুস্বামীরাই ছিলেন শাসন ব্যবস্থা প্রধান ব্যক্তি। শাসন পরিচালনা , রাজস্ব সংগ্রহ , সৈন্য সংগ্রহ - ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ভুস্বামীগণ প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। 


৩.ভূস্বামীদের প্রতি কেন্দ্রীয় শক্তির নির্ভরশীলতা :- ভুস্বামীরা রাজস্ব সংগ্রহ করতেন এবং যুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শক্তি বা রাজাকে সৈন্য সরবরাহ করতেন। ফলে রাজার কেন্দ্রীয় শক্তি বহুলাংশে সামন্তপ্রভুদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে সামন্ততন্ত্রের যুগে কেন্দ্রীয় শক্তি কখনোই চূড়ান্ত শক্তিশালী হতে পারতো না। 

৪. ভূস্বামী ও কৃষকদের পারস্পরিক সস্পর্ক :- যদিও ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক ছিল , কিন্তু সেই সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে ছিল শাসক ও শোষিতের সম্পর্ক। তৎকালীন সময়ে সামন্তপ্রভুরা বিভিন্ন ধরণের কর চাপিয়ে কৃষকদের শোষণ করতো। রাজস্বের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। এছাড়া প্রভুর জমিতে ভূমিদাসদের বেগার শ্রম প্রদান করতে হত। 

৫. কৃষকের উপর বিভিন্ন ধরণের করের বোঝা :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের কর ও রাজস্ব প্রচলিত ছিল। যেমন - সম্পত্তি কর বা Taille , বেগার শ্রম বা Corvee , উৎপাদন কর বা Metayage , পণ্য বিক্রি সংক্রান্ত কর বা Benalities , ভূমিদাসদের জন্য ছিল Capitatio , ফসল কাটার সময় Prestation কর। এছাড়াও চার্চগুলি কৃষকদের কাছ থেকে Tithe বা ধর্মকর আদায় করতো। 

৬. সৈন্যবাহিনীর সংগঠন :- যেহেতু মূলতঃ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার তাগিদেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল , তাই প্রতিটি সামন্তপ্রভুকে একটি সুসংগঠিত সৈন্যদল নিয়োজিত রাখতে হত। এদের মূল কাজ ছিল দুটি - (ক ) বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা এবং (খ ) যুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শক্তি বা রাজাকে সৈন্য সরবরাহ করা। বীর যোদ্ধাগন '' নাইট '' নামে পরিচিত ছিলেন। 

৭. ম্যানর হাউস ও ম্যানর প্রভু :- সামন্ততন্ত্রের সাংগঠনিক দিকের প্রধান একক ছিল ম্যানর হাউস। এক একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে এক একটি ম্যানর হাউস গড়ে উঠত এবং এই ম্যানর হাউস থেকেই সামন্ত প্রভুরা গ্রামের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতেন। কৃষকদের কৃষিকাজে নিযুক্ত রাখা , রাজস্ব সংগ্রহ , উৎপাদন ও জমি পরিচালনা - ইত্যাদি সমস্ত কিছুই ম্যানর হাউস থেকে পরিচালিত হত। 

৮. ম্যানর দুর্গ :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ম্যানর হাউসের সাথে সাথে ম্যানর দুর্গেরও অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। ম্যানর দুর্গগুলি মূলতঃ তৈরী হত নিরাপত্তার তাগিদে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। এই দুর্গগুলি নিরাপত্তাবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতো। 


৯. আনুগত্য প্রদর্শনকারী শ্রেণীর উদ্ভব :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অধঃস্তন কর্তৃপক্ষের আনুগত্য প্রদর্শন। সামন্ততান্ত্রিক পিরামিডে অবস্থানকারী সকল ব্যক্তি ও অধঃস্তন সামন্তগণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতেন। 

১০. শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত :- যেহেতু সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ গ্রামীণ এবং কৃষিনির্ভর সেহেতু এই সময়কালে শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। শুধুমাত্র কৃষিজাত উৎপাদন মানুষের সমস্ত চাহিদাকে তৃপ্ত করতে সমর্থ ছিল না। 

১১. কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকতার অভাব :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষি ছিল অর্থনীতির ভিত্তি। কিন্তু কৃষিকাজ ছিল আদিম পদ্ধতি নির্ভর। কৃষিকাজে কোনোরূপ আধুনিক যন্ত্র বা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হত না। অন্যদিকে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় প্রথাগত উৎপাদন ব্যবস্থা চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে যোগান দিতে অসমর্থ ছিল। 

১২. নিম্ন ও পশ্চাদাভিমুখী ব্যবস্থা :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই আধুনিক আর্থ - সামাজিক ব্যবস্থার তুলনা করা যায় না। এই ব্যবস্থা ছিল নিম্নমুখী ও তাতে অগ্রগতি ও আধুনিকতার কোনো লক্ষণ প্রকাশিত ছিল না। 
(i)কৃষি ব্যবস্থা ছিল গতানুগতিক , 
(ii) কৃষিতে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া ছিল না , 
(iii) জ্ঞান - বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সামন্তপ্রভুরা কোনো আগ্রহ দেখাননি ,
(iv) সমাজে পরিবর্তনশীলতা ছিল খুব কম , 
(v) সমাজে সচলতার পথ ছিল রুদ্ধ , 
(vi) মানুষের জীবন সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল না , 
(vii) সমাজে ভূমিদাস প্রথার অস্তিত্ব ছিল , 
(viii) কৃষকদের উপর শোষণ অব্যাহত ছিল , 
(ix) শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন খুবই কম ছিল , 
(x) নাগরিক সভ্যতার অবক্ষয় ঘটেছিল।   
এই সকল কারণে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিম্নমানের ও পশ্চাদমুখী ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে।



You May Also Like

0 comments