আকবরের ধর্মনীতি ও দীন - ই - ইলাহী - র রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা কর।

by - December 29, 2021

আকবরের ধর্মনীতি সম্পর্কে আলোচনা কর। আকবরের ধর্মনীতি ও দীন - ই - ইলাহী - র রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা কর।  

Discuss Akbar's theology. Discuss the political significance of Akbar's religious policy and Deen-e-Ilahi. ( In Bengali ) 



আকবরের ধর্মনীতি :- 

ভারতের মুসলিম শাসকদের মধ্যে আকবরই ছিলেন সর্বপ্রথম যিনি হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করে তাদের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন। ধর্মনীতির ক্ষেত্রেও এই উদারতা লক্ষ্য করা যায়। আকবরের ধর্মনীতির মধ্যে সকল ধর্মের সমন্বয় , সহিষ্ণুতা ও সকল ধর্মের কল্যাণকর দিকগুলির সংযোজন লক্ষ্য করা যায়। 


আকবর কর্তৃক উদার ধর্মনীতি গ্রহণের কারণ :-

আকবর ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করেন। এর কারণগুলি ছিল - 
(i) তৈমুর লঙের বংশধর তথা আকবরের পূর্বপুরুষরা সুফী মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। এই আদর্শে আকবর অনুপ্রাণিত হন। 
(ii) রাজপুত মহিষীগণের উদার ধর্মীয় মনোভাব আকবরকে প্রভাবিত করেছিল। 
(iii) আকবরের গৃহশিক্ষক আব্দুল লতিফ ছিলেন একজন উদার মানবতাবাদী। তার শিক্ষা আকবরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 
(iv) শেখ মোবারক , আবুল ফজল প্রমুখের সংস্পর্শে এসে তিনি ইসলামের গোঁড়ামি সম্পর্কে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। 
(v) আকবরের শৈশব কেটেছিল পারস্য ও কাবুলে। এইসময় তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। 
(vi) বৈরাম খাঁ -র তত্ত্বাবধানে আকবর বাল্যকাল থেকেই বিভিন্ন সুফী সাধকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। তাঁদের উদার ধর্মীয় মানসিকতা আকবরকে প্রভাবিত করে। 
(vii) এছাড়াও , আকবর উপলব্ধি করেছিলেন যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে গোঁড়া ইসলামিক নীতি প্রবর্তন করলে তা মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে অনুকূল হবে না। তাই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে আকবর ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন বলে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন। 

আকবরের ধর্মনীতির তিনটি পর্যায় :- 


আকবরের ধর্মীয় জীবনকে এবং তাঁর ধর্মনীতিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় - যথা :- 

প্রথম পর্যায় : ১৫৭৫ পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলমান ছিলেন। এইসময় তিনি ইসলামের যাবতীয় রীতিনীতি মেনে চলতেন। 

দ্বিতীয় পর্যায় : ১৫৭৫ এর পর থেকে তাঁর ধর্মনীতির দ্বিতীয় পর্যায় ধরা হয়। এই পর্যায়ে তিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে সকল ক্ষমতা নিজ করায়ত্ত করতে সচেষ্ট হন এবং একটি দলিল প্রকাশ করে তিনি রাষ্ট্র ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সম্রাটের সর্বোচ্চ ক্ষমতা স্থাপন করেন। এই দলিলকে স্মিথ Infallibility Decree বলে অভিহিত করেছেন। এই নির্দেশনামার মূল বিষয় ছিল ধর্মীয় সকল ক্ষেত্রে সম্রাটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এছাড়া ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে শুধমাত্র মুসলিম পন্ডিতেরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় গোঁড়ামি লক্ষ্য করে আকবর ইবাদতখানা বন্ধ করে দেন। এরপর ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ইবাদতখানা আহ্বান করা হয় এবং এইবার মুসলিম সহ সকল ধর্মের পন্ডিতদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো হয়।     

তৃতীয় পর্যায় : দীন - ই - ইলাহী প্রবর্তন :- আকবরের ধর্মনীতির তৃতীয় পর্যায় হল দীন - ই - প্রবর্তন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দীন - ই - ইলাহী প্রবর্তন করেন। সকল ধর্মের উদার ও মানবতাবাদী বৈশিষ্টগুলিকে তিনি তাঁর নতুন একেশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্বে স্থান দেন। বদাউনী এই মতবাদকে '' তৌহিদ - ই - ইলাহী '' বা স্বর্গীয় একেশ্বরবাদ বলে অভিহিত করেছেন। সকল ধর্মমতের সারবস্তু নিয়ে গঠিত হয় এই নতুন ধর্মমত। যেমন - হিন্দুদের উপাসনা , জন্মান্তরবাদ ; বৌদ্ধ ও জৈনদের অহিংসা ; ইসলামের পবিত্রতা ইত্যাদি। এই নতুন ধর্মমতে ধর্মগুরু বা পুরোহিতের কোনো স্থান ছিল না। কোনো বিশেষ ধর্মীয় রীতিনীতিরও কোনো স্থান ছিল না। 

স্মিথের মতামত :- স্মিথ আকবরের দীন ই ইলাহীর সমালোচনা করে বলেছেন - দীন - ই - ইলাহি ছিল ইসলাম বিরোধী একটি ধর্মমত এবং তা ছিল আকবরের নির্বুদ্ধিতার চরম নিদর্শন। কিন্তু স্মিথের এই মন্তব্য সমর্থনযোগ্য নয় ; কেননা , দীন - ই - ইলাহি কোনো নতুন ধর্মমত ছিল না এবং আকবর কাউকে এই ধর্মমত গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। দীন - ই - ইলাহী ছিল প্রকৃতপক্ষে আকবরের একটি নীতি যার মাধ্যমে আকবর নানা জাতি , ধর্ম , ভাষা , সংস্কৃতি অধ্যুষিত ভারতবর্ষকে এক সূত্রে গ্রথিত করতে চেয়েছিলেন। 

বদাউনির মতামত :- বদাউনির মতে আকবর দীন ই ইলাহি প্রবর্তন করার পর নানাবিধ ইসলাম বিরোধী নীতি প্রবর্তন করেন। তিনি গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করেন ; রমজানের উপবাস ও মক্কা ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু বদাউনির এই বক্তব্য পক্ষপাত দুষ্ট। কেননা , (ক ) তিনি জনশ্রুতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। (খ ) বদাউনী ছিলেন আকবরের প্রবল সমালোচক। (গ ) আবুল ফজল অতিরিক্ত রাজানুগ্রহ লাভ করায় তিনি আকবরের উপর রুষ্ট ছিলেন। বস্তুতঃপক্ষে গোঁড়া মুসলিম ও মৌলবীরা নিজেদের প্রভাব কমে যাওয়ার ভয়ে এইসকল অভিযোগগুলি করেন। 


আকবরের ধর্মনীতি তথা দীন - ই - ইলাহী - র রাজনৈতিক গুরুত্ব :- 

প্রথমতঃ দীন - ই - ইলাহী প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় জনসাধারণ আকবরকে সম্পূর্ণ ভারতীয় ও প্রজাহিতৈষী বলে গ্রহণ করছিল। 
দ্বিতীয়তঃ বহু জাতি , বহু ভাষা , বহু ধর্ম অধ্যুষিত ভারতে জাতীয় ঐক্যের উন্মেষের পথ প্রশস্ত করেছিল দীন - ই - ইলাহী। 
তৃতীয়তঃ ধর্মান্ধ ও গোঁড়া উলেমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়েছিল। 
চতুর্থতঃ ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে আকবরের সর্বময় নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 
পঞ্চমতঃ অধ্যাপক আতাহার আলি মনে করেন , বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিয়ে আকবর প্রশাসন ও মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করেছিলেন। 
ষষ্ঠতঃ সুল - হি - কুল প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি সর্বভারতীয় নেতায় পরিণত হন। 
সপ্তমতঃ হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ অনেকটা দূর হয়। 
অষ্টমতঃ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এক নতুন চিন্তা - ভাবনার সূচনা হয়। 
নবমতঃ দীন - ই - ইলাহীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকটি হল - এই নীতি প্রবর্তনের ফলে তিনি হিন্দুদের অকুন্ঠ সমর্থন লাভ করেন।     


You May Also Like

0 comments