ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের কারণ :- causes of the February Revolution in France in 1848.

by - December 29, 2021

Discuss the causes of the February Revolution in France in 1848. 

ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের কারণগুলি আলোচনা কর। 

ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের কারণ :- 


দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত বুরবোঁ রাজবংশের পতন ঘটে। জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। লুই ফিলিপ ১৮৩০ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর এই শাসনকালকে বলা হত '' জুলাই রাজতন্ত্র ''। এরপর ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে লুই ফিলিপের শাসন ক্ষমতার অবসান ঘটে। ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের কারণগুলি ছিল - 


১. মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্য সংকট :- ইউরোপের রাজনীতির মূলকেন্দ্র হলেও ফ্রান্স ছিল একটি কৃষিনির্ভর দেশ। ১৮৪০-৪২ এর পর থেকেই ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের অপদার্থতার কারণে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে থাকে। অন্যদিকে এই সময় থেকে কৃষিতেও মন্দা দেখা যায়। পোকার উপদ্রব , খরা , অনাবৃষ্টি ইত্যাদির ফলে আলু , গম ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে ফ্রান্সে খাদ্য দ্রব্যের তীব্র মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ফসলের দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পজাত পণ্যগুলির ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। লুই ফিলিপ এই সংকট মোচনে ব্যর্থ হন। 

২. রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতা :- সিংহাসনলাভের পর লুই ফিলিপের সামনে প্রধান তিনটি  রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। একদিকে উদারপন্থীরা লুই ফিলিপের কাছ থেকে আশা করেছিল যে তিনি ফ্রান্সে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসন চালু করবেন এবং অন্যদিকে বুরবোঁ রাজবংশের সমর্থকেরা লুই ফিলিপের সিংহাসনলাভকে অবৈধ বলে মনে করতেন। আবার , বোনাপার্টিস্ট দল নেপোলিয়নের গৌরবময় শাসনের সাথে তুলনা করে লুই ফিলিপের দুর্বল নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। 


৩. রাজতন্ত্রের বুর্জোয়া নির্ভরতা :- প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে লুই ফিলিপ বুর্জোয়াদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই নির্ভরশীলতা এতটাই ছিল যে , ঐতিহাসিক তকভিল বলেছেন ধনী বুর্জোয়া শ্রেণি লুই ফিলিপকে একটি শিল্পোদ্যোগ হিসেবে মনে করতেন। লুই ফিলিপ শুল্ক সংরক্ষণ নীতির দ্বারা বুর্জোয়াদের মুনাফা লাভের সুযোগ করে দেন। এই সমস্ত কারণে লুই ফিলিপের রাজত্বকালকে '' বুর্জোয়া রাজতন্ত্র '' বলা হয়। 

৪. শিল্প শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য :- লুই ফিলিপের বুর্জোয়া তোষণের ফলে ফ্রান্সে বুর্জোয়াদের হাত ধরে কল - কারখানার বিকাশ ঘটলেও শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। শ্রমিকরা শহরের বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতো। তাদের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। লুই ফিলিপ উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকদের স্বার্থে কোনো নীতি প্রবর্তন করেননি। ফ্রান্সের বুর্জোয়া মালিকরা সীমাহীন শোষণের মাধ্যমে যে সংকট সৃষ্টি করে রাজতন্ত্রের উপরেও তার প্রভাব পড়ে। 

৫. দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি :- লুই ফিলিপের বিচ্ছিন্নতার নীতি ফরাসীবাসীরা সমর্থন করেননি। তিনি নেপোলিয়নের মত কোনো গৌরবোজ্জ্বল বৈদেশিক নীতি গ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয়তার নীতি গ্রহণ করেন। ইতালি ও পোল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকতেও তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। নিকট প্রাচ্যের সমস্যাতেও লুই ফিলিপের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। 

৬. নিম্ন বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়াদের ভোটাধিকার দাবী :- নিম্ন বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়াগণ ছিলেন শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত। তাঁরা শিক্ষা , আইন , সরকারি চাকুরী - ইত্যাদি পেশায় নিযুক্ত থাকতেন। কিন্তু ফ্রান্সে পাতি বুর্জোয়াদের ভোটাধিকার ছিল ১৫০ জন পুরুষ নাগরিকের মধ্যে মাত্র ১ জনের। তাঁরা লা - মার্টিন , থিয়ার্স প্রমুখের নেতৃত্বে ভোটাধিকারের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। 


৭. লুই ফিলিপের মধ্যপন্থার নীতি :- লুই ফিলিপ নাগরিকদের সমর্থনে ফ্রান্সের সিংহাসন গ্রহণ করেন। তাই তাঁর সিংহাসন নাগরিকদের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই লুই ফিলিপ প্রথমদিকে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত আদর্শগুলির প্রতি সমর্থন জানালেও প্রকৃত ক্ষেত্রে তিনি মধ্যপন্থার নীতি অবলম্বন করেন। ফলে , ফ্রান্সের সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে তিনি ব্যর্থ হন। 

৮. সেপ্টেম্বর আইন :- এরপর লুই ফিলিপ সেপ্টেম্বর আইন নামক এক প্রতিক্রিয়াশীল আইন জারি করেন। এই আইনের মূল বিষয়গুলি ছিল - 
(i) সরকারবিরোধী সর্বপ্রকার সমালোচনা নিষিদ্ধ করা হয়। 
(ii) বিচারের ক্ষেত্রে জুরি প্রথা বাতিল করা হয়। 
(iii) সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়। 
(iv) বৈদেশিক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তার নীতি গৃহীত হয়। 

৯. প্রত্যক্ষ কারণ : ২২ শে ফেব্রুয়ারী গুলিবর্ষণের ঘটনা :- সেপ্টেম্বর আইনের প্রতিবাদে ও লুই ফিলিপের সামগ্রিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে উদারপন্থীরা প্যারিসে এক সভার আয়োজন করে। কিন্তু সরকার ওই সভা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে জনগণ প্রধানমন্ত্রী গিজো- র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সামিল হন। এই সময় গিজোর দেহরক্ষীরা জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করলে ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। 

জনগণের উপর এই আক্রমণের প্রতিবাদে প্যারিসের সর্বত্র তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। পুরো ফ্রান্সে চরম উত্তেজনা তৈরী হয়। এরপর প্যারিসের নাগরিকরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে ও রাজার পদত্যাগ দাবী করে। ফ্রান্সের সর্বত্র তীব্র দাঙ্গা - হাঙ্গামা তৈরী হয়। শ্লোগান তৈরী হয় - Long live reform . এরপর ২৪ শে ফেব্রুয়ারী লুই ফিলিপ নিজ পৌত্রের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু জনগণ ২৬ শে ফেব্রুয়ারী লা - মার্টিনের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র্রের অবসান করে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।     



You May Also Like

0 comments