জুলাই বিপ্লবের কারণ :- Causes of July Revolution in France in 1830

by - December 27, 2021

Causes of July Revolution in France in 1830 

ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের কারণগুলি লেখ। 


জুলাই বিপ্লবের কারণ :- 


১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসে ন্যায্য অধিকার নীতি গৃহীত হয় এবং এই নীতি অনুসারে ফ্রান্স বুরবোঁ রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের নতুন ভাবধারা ও জাতীয় সংবিধানের আদর্শ অনুসারে শাসন পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।  রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা রাজার স্বার্থের তুলনায় রাজতন্ত্র , চার্চ ও অভিজাতদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে অধিক তৎপর ছিল এবং অন্যদিকে উদারপন্থীরা বিপ্লবের ভাবধারা ও আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখতে তৎপর ছিলেন। এই দুই আদর্শগত দ্বন্দ্বের মধ্যে অষ্টাদশ লুই সমন্বয়ের নীতি গ্রহণ করলেও পরবর্তী রাজা দশম চার্লস প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করলে তা নতুন একটি বিপ্লবের সূচনা করে। ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের বিভিন্ন কারণগুলি ছিল - 


১. ডেভিড থমসনের তত্ত্ব :- অষ্টাদশ লুই উদারনৈতিক ভাবধারার সঙ্গে রাজতন্ত্রের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যু হলে পরবর্তী সম্রাট দশম চার্লস এই সমন্বয়বাদী নীতি পরিত্যাগ করে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করেন। তিনি পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। দশম চার্লসের এই প্রতিক্রিয়াশীল নীতিগুলি ফ্রান্সের নতুন ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। দশম চার্লস যদি অষ্টাদশ লুইয়ের নীতি অনুসরণ করে চলতেন তাহলে ফ্রান্স জুলাই বিপ্লব অনিবার্য হত না। 

২. বিপরীত মত : বিপ্লবের অনিবার্যতা তত্ত্ব :- কিন্তু উদারপন্থীরা ডেভিড থমসনের উক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে জুলাই বিপ্লব অনিবার্য ছিল। কেননা , পুরাতনতন্ত্র ও বিপ্লব প্রসূত নতুন ভাবধারার মধ্যে কোনোভাবেই সমন্বয়সাধন সম্ভব ছিল না। দুটি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীমুখী আদর্শ। অষ্টাদশ লুই সমন্বয়ের নীতি গ্রহণ করলেও তিনি কার্যকর কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন নি। 


৩. নাগরিকদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত বিষয় :- জাতীয় সংবিধানে নাগরিকদের ভোটাধিকারের বিষয়েও বৈষম্য ছিল। কেবলমাত্র ধনী অভিজাত ও বুর্জোয়াদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। তিরিশ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে মাত্র ৯০ হাজার নাগরিকের ভাটাধিকার স্বীকৃত হয়। শুধুমাত্র সম্পদের ভিত্তিতে এই অধিকার দেওয়া হয়। ফলে যে সকল শিক্ষিত , সমাজ ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা উচ্চ সম্পদ সম্পন্ন ছিলেন না , তারা ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত হন। 

৪. সনদের ১৪ নং ধারার অপব্যবহার :- জাতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারায় ফরাসি সম্রাটকে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকার প্রয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অষ্টাদশ লুই ও দশম চার্লসকে ওই বিশেষ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দেখা যায়। 

৫. অষ্টাদশ লুইয়ের ভূমিকা :- অষ্টাদশ লুই জাতীয় সংবিধানের সঙ্গে বিপ্লব প্রসূত ভাবধারার সমন্বয়ের প্রয়াস করেন। তিনি একদিকে রাজতন্ত্রের ঐতিহ্যকে বজায় রাখেন আবার অন্যদিকে নেপোলিয়নের যুগের ভূমি ব্যবস্থা , বিভিন্ন সংস্কার ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে মোটামুটি বহাল রাখেন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অষ্টাদশ লুইয়ের মন্ত্রিসভা বামপন্থী ও উদার - পন্থীদের এড়িয়ে মধ্যবর্তী পন্থা গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা ব্যর্থ হন এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতালাভ করেছিল। 

৬. দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি :- অষ্টাদশ লুইয়ের পর দশম চার্লস ফ্রান্সের সিংহাসন গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল নীতির মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলেন। তিনি আইন পরিষদকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মন্ত্রীদের নিয়োগ ও পদচ্যুত করতে শুরু করেন। তিনি প্রাক ফরাসি বিপ্লবের অবস্থায় ফ্রান্সকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। অভিজাত ও যাজকদের গৌরব ও ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও তিনি পলিগ্যনাক নামে এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রী নিযুক্ত করেন।   


৭. জুলাই অর্ডিন্যান্স :- প্রতিক্রিয়াশীলতার চরম পর্যায়ে দশম চার্লস জুলাই অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এতে মূলতঃ চারটি প্রতিক্রিয়াশীল নির্দেশের সমাবেশ ঘটে। 
(i) ফ্রান্সের প্রতিনিধিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। নবগঠিত প্রতিনিধিসভায় রাজা কর্তৃক মনোনীত সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।             
(ii) জনসাধারণের ভোটাধিকার আরো সীমাবদ্ধ করা হয়। মাত্র পঁচিশ হাজার মানুষ ভাটাধিকার লাভ করেন। 
(iii) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়। 
(iv) ১৮১৪ সালের জাতীয় সংবিধানকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। 

৮. জনগণের প্রতিক্রিয়া ও বিপ্লবের সূচনা :- এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উদারপন্থী নেতা এডলফ থিয়ার্স এর নেতৃত্বে প্যারিসের জনগণ বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। সাধারণ মানুষ , ছাত্র ও শ্রমিকেরা সারা প্যারিস জুড়ে ব্যারিকেড গড়ে তোলে। প্যারিস নগরী বিপ্লবের কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রজাতন্ত্রী দলের নেতা ক্যাভিগনাকের নেতৃত্বে প্যারিসের ছাত্ররা সর্বত্র অবরোধ সৃষ্টি করে। এরপর জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্য সেনা সমাবেশ ঘটলে জনগণ বিদ্রোহ শুরু করে। বোনাপার্টিস্টরাও প্রজাতন্ত্রীদের সাথে যোগ দেয়। পূর্বতন জাতীয় রক্ষিবাহিনীও বিপ্লবে যোগদান করে। 

৯. দশম - চার্লসের পদত্যাগ :- প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সের জনগণের ক্ষমতা সম্পর্কে পলিগ্যনাকের কোনো ধারণাই ছিল না। ২৮ শে জুলাই প্যারিসের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে জনগণের হাতে চলে যায়। ৩০ শে জুলাই বিদ্রোহীরা অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের রাজা বলে ঘোষণা করেন। এই সময় দশম চার্লস পলিগ্যনাককে অপসারণ করতে ও অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে সম্মত হলেও ফ্রান্সের জনগণ দশম চার্লসের পদত্যাগের দাবীতে অটল ছিল। ফলে দশম চার্লস সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 

পরিশেষে বলা যায় , ফরাসি বিপ্লব প্রসূত উদারনৈতিক ভাবধারাগুলিকে প্রশমিত করার চেষ্টাই জুলাই বিপ্লব অনিবার্য করে তোলে। তবে জুলাই বিপ্লবের ফলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলেও জনগণের অধিকার ও ফরাসি বিপ্লব প্রসূত আদর্শগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়।    


You May Also Like

0 comments