স্কন্ধগুপ্ত বিক্রমাদিত্য :- Skandhagupta : A protector of India from Hunas .

by - July 09, 2021

স্কন্ধগুপ্ত  বিক্রমাদিত্য :-  ( ৪৫৫ - ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ ) : হূন আক্রমণ থেকে ভারত রক্ষাকারী হিসেবে স্কন্ধগুপ্তের কৃতিত্ব। 




কিছু ঐতিহাসিক কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত বংশে উত্তরাধিকারসূত্র নিয়ে বিরোধের উল্লেখ করেছেন। কুমারগুপ্তের প্রথম মহিষী অনন্তদেবীর পুত্র ছিলেন পুরগুপ্ত এবং স্কন্ধগুপ্ত ছিলেন কুমারগুপ্তের দ্বিতীয় মহিষী দেবকীর পুত্র। সম্ভবতঃ সেই কারণেই সিংহাসনের ওপর স্কন্ধগুপ্ত অপেক্ষা পুরগুপ্তের দাবী ছিল অধিক। তাই অনেকে মনে করেন , ভাতৃবিরোধের মাধ্যমেই স্কন্ধগুপ্ত রাজা হয়েছিলেন। 

একদিকে ডক্টর রায়চৌধুরী বলেছেন , ভিতরীর স্তম্ভলেখাতে এমন কিছু নেই যার দ্বারা ভাতৃবিরোধ প্রমাণিত হয়। তাঁর মতে , প্রথম কুমারগুপ্তের  রাজত্বকালের শেষের দিকে সংগ্রাম ছিল একান্তভাবে পুষ্যমিত্র এবং হুন ইত্যাদি বহিঃ শত্রুর সঙ্গে। 


আবার অন্যদিকে , ডক্টর মজুমদার ভাতৃবিরোধের সম্ভাবনাকে স্বীকার করেছেন এবং তিনি সিংহাসনে স্কন্ধগুপ্তের বৈধ অধিকারের প্রশ্নটিকে তুলে ধরেছেন। যেমন , ভিতরী লেখতে গুপ্তদের চিরাচরিত প্রথা অনুসারে স্কন্ধগুপ্তের পূর্বতন সব রাজা ও রানীর নাম যথাযোগ্য আড়ম্বরের সাথে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে স্কন্ধগুপ্তের মায়ের নামের কোনো উল্লেখ নেই। তাই মনে করা হয় , স্কন্ধগুপ্তের মাতৃপরিচয় কোন গর্বের বিষয় ছিল না। হয়তো তিনি প্রথম কুমারগুপ্তের মহিষী ছিলেন না। তাই তার পুত্রের সিংহাসনলাভের বৈধ অধিকার ছিল কি'না - সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। 

স্কন্ধগুপ্ত তার লেখগুলিতে বারবার নিজেকে '' গুপ্ত বংসৌক বীর '' বলে ঘোষণা করেছেন। এ থেকে মনে করা হয় যে , স্কন্ধগুপ্ত তার মাতৃ পরিচয়ের জন্য হীনমন্যতায় ভুগতেন ,  তাই তিনি যে গুপ্ত বংশীয় - সে কথাই বারবার ঘোষনা করতেন। 

তবে সাধারণভাবে ঐতিহাসিকেরা বিশ্লেষণ করে থাকেন যে , কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর পুরগুপ্ত সিংহাসনারোহণ করেন ; কিন্তু শীঘ্রই বৈমাত্রেয় ভ্রাতা স্কন্ধগুপ্ত পুরগুপ্তকে পরাজিত করে সিংহাসনারোহণ করেন এবং '' বিক্রমাদিত্য '' উপাধি ধারণ করেন। আর্যমনজুশ্রী মূলকল্প নামক গ্রন্থে স্কন্ধগুপ্তকেই কুমারগুপ্তের উত্তরাধিকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। 


স্কন্ধগুপ্তের রাজনৈতিক জীবন :- 


স্কন্ধগুপ্ত ছিলেন গুপ্তবংশের সর্বশেষ শক্তিশালী রাজা। সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পরেই তাকে হুন জাতির আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। '' ভিতরী স্তম্ভলিপি ''- তে হুনদের সঙ্গে স্কন্ধগুপ্তের যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুনাগর শিলালেখ থেকেও স্কন্ধগুপ্ত সম্পর্কে জানতে পারা যায়। 

পশ্চিম ও উত্তর সীমান্তে প্রবল আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য বিপন্ন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু স্কন্ধগুপ্ত এই আক্রমণ প্রতিহত করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অখন্ডতা রক্ষা করতে সমর্থ হন। এর ফলে শুধু যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অখন্ডতা রক্ষা পেয়েছিল এমন নয় ; সমগ্র ভারত উপমহাদেশ এক ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছিল। স্কন্ধগুপ্তের এই বিরাট সাফল্যের ফলে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হুনরা ভারতে আক্রমণ করতে সাহসী হয়নি। ডক্টর মজুমদার মনে করেন , এই বিরাট কৃতিত্বের জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে ভারতের ইতিহাসে স্কন্ধগুপ্ত চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাসেই নয় ; স্কন্ধগুপ্ত কর্তৃক হুনদের পরাজয় সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই পরাজয়ের ফলে হুনগণ পূর্ব ইউরোপের দিকে ধাবিত হয়। 

কে এম পানিকরের ভাষায় , At the height of Hun power , by this defeat , its movement was turned west and the continuous pressure on Eastern Europe arose in fact , from the failure of the Huns to force an entry to India .''  


Dr. R.K. Mukherjee - র মতে , স্কন্ধগুপ্তের হুন যুদ্ধকে '' ধর্মবিজয় ''  বলে অভিহিত করা যেতে পারে।  কারণ তিনি পরাজিত শত্রুর প্রতি সদয় ব্যবহার করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্কন্ধগুপ্তের আমলে দাক্ষিণাত্যের বকাটকরা গুপ্ত সাম্রাজ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে , কিন্তু স্কন্ধগুপ্ত বীরত্বের সঙ্গে তা প্রতিহত করেন। এছাড়া , সোমদেব কর্তৃক রচিত '' কথাস্মৃতি সাগর '' নামক গ্রন্থে  স্লেচ্ছদের  বিরুদ্ধে স্কন্ধগুপ্তের জয়লাভের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকে এই স্লেচ্ছ বলতে কুষাণদের   কথা মনে করে থাকেন। স্কন্ধগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়ে তারা সম্ভবতঃ উত্তর-পশ্চিম ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। পশ্চিমে কাথিয়াবাড় থেকে পূর্বে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর স্কন্ধগুপ্ত নিজ প্রভুত্ব বজায় রেখেছিলেন। পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র , গুজরাট ও মালব তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। 


স্কন্ধগুপ্তের কৃতিত্ব :- 


হুন আক্রমণ প্রতিহত করা স্কন্ধগুপ্তের শ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে বিবেচিত হয়। ভিতারি স্তম্ভ লেখতে কোনো তারিখ না থাকায় এই হুন আক্রমণ ঠিক কখন হয়েছিল তা বলা কঠিন। তৎকালীন হুন নেতা '' এটিলা '' দানিয়ুব নদীর তীর থেকে সিন্ধু নদীর তীর পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসকার্য চালিয়েছিলেন - এ কথা মনে রাখলেই হুনদের বিরুদ্ধে স্কন্ধগুপ্তের সাফল্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। '' আর্যমনজুশ্রী মূলকল্প '' নামক গ্রন্থের সমর্থনে ডক্টর কে পি জয়সোয়াল স্কন্ধগুপ্তকে '' শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও ধর্মপরায়ন রাজা '' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে , গুপ্ত সম্রাটদের মধ্যে স্কন্ধগুপ্তই ছিলেন শ্রেষ্ঠ।  এশিয়া ও ইউরোপে তিনিই ছিলেন একমাত্র যোদ্ধা যিনি বর্বর ও দুর্ধর্ষ হুনদের সাফল্যের সঙ্গে পরাজিত করেছিলেন। 

" All over the vast empire the people must have heaved a sigh of relief at the great deliverance .'' 
- Dr. R. C. Mazumdar .   

শুধু যোদ্ধা হিসেবেই নয় , দক্ষ ও জনহিতকর শাসক হিসাবেও স্কন্ধগুপ্তের কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না।  '' জুনাগর শিলালিপি '' - তে তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উদ্দেশ্যে যে উপদেশ দিয়েছিলেন , তা থেকে মনে হয় , তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী শাসক। সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদের সংস্কার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। হিউয়েন সাং - এর বিবরণী থেকে জানতে পারা যায় যে , তিনি নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। সম্ভবতঃ  ৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্কন্ধগুপ্ত চীনের নিকট দূত পাঠান। 


You May Also Like

0 comments