Reasons for the decline of Buddhism : বৌদ্ধ ধর্মের অবনতির কারণ :-

by - July 09, 2021

বৌদ্ধ ধর্মের অবনতির কারণ :- 




বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার যেমন একটি বিশেষ যুগে ঘটেনি , সেরকম পতনও ধীরে ধীরে দীর্ঘকাল ধরে ঘটেছিল। এর অবনতিরও একাধিক কারণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন :- 

রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব : ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা :- 
মৌর্য যুগের অবসানের পর থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। কনিষ্ক ও হর্ষবর্ধন ছাড়া কোন নৃপতিই বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরোধ দেখাননি। গুপ্ত রাজাদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনুরাগ এবং শঙ্করাচার্য , কুমারিলভট্ট প্রমুখ হিন্দু সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। 


হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের অভিন্নতা :- 
সপ্তম ও অষ্টম খ্রিস্টাব্দে সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবিত হলে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের তপস্যাবাদ ও ভক্তিবাদ যথাক্রমে শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় আয়ত্ত করে। এর ফলে হিন্দুপুরাণে বর্ণিত যোগরত শিবের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের আর পার্থক্য থাকল না। জগন্নাথ , বলরাম ও সুভদ্রার রথযাত্রা , মন্দির , পূজার জাঁকজমক , ভক্তিবাদ অথবা ঈশ্বরকে মনুষ্যজ্ঞানে অর্চনা করা এই সমস্তই বৌদ্ধধর্ম থেকে পুনরুজ্জীবিত হিন্দু ধর্মে গৃহীত হয়। 

বঙ্গদেশের পাল রাজাদের রাজসভায় হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্ত্রীরা সমান আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময় বৌদ্ধ - হিন্দু নির্বিশেষে সকলেই পাণিনি রচিত ব্যাকরণ এবং সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ন্যায়শাস্ত্র চর্চা করত।  হিন্দুরা বুদ্ধকে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের অভিন্নতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়। সারনাথে আবিষ্কৃত শিবলিঙ্গকে '' শিবসঙ্ঘেশ্বর ''  অর্থাৎ সংঘের প্রভু বলে অভিহিত করা হয়েছে। 

উপরন্তু , কুমারিলভট্ট , শঙ্করাচার্য , রামানুজ প্রমুখ হিন্দু সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় জনসাধারণের নিকট হিন্দুধর্মের আবেদন উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মের আবেদন হ্রাস পায়।মহাযান মতের উৎপত্তি ও মূর্তিপূজার প্রচলন হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে ব্যবধান অনেকখানি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। 


ভাবজগতে বৌদ্ধদের পরাজয় :- 
অশোকের সময় থেকেই ভাবজগতে বৌদ্ধদের সৃজনীশক্তির ক্রমাবনতি হতে থাকে। সুচতুর ও জ্ঞানী হিন্দু সংস্কারকদের সঙ্গে বৌদ্ধরা ভাবজগতের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাফল্য লাভ করতে পারেনি। কণিষ্কের পর ভারতে প্রতিভাসম্পন্ন বৌদ্ধ পন্ডিত বা সন্ন্যাসীর আর আবির্ভাব ঘটে নি। 

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতভেদ : হীনযান ও মহাযান :- 
বুদ্ধদেবের দেহত্যাগের একশত বছরের মধ্যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতানৈক্য ও পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়ের উদ্ভবের ফলে বৌদ্ধধর্মের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয় এবং এই ধর্মের অবনতির গতি ত্বরান্বিত হয়। বৈশালীতে আহূত বৌদ্ধসংঘের এবং সম্মেলনে বৌদ্ধদের মধ্যে মতানৈক্য চরম আকার ধারণ করে। সর্বশক্তিমান পোপ বা ধর্মগুরু না থাকায় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য অক্ষুন্ন রাখা অসম্ভব হয়।  বৈশালী সম্মেলনে হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার তুলনায় তাদের হিন্দু বিরোধিতা ম্লান হয়ে পড়ে। 

বৌদ্ধসংঘের দুর্নীতি :- 
বৌদ্ধসংঘের নানাবিধ দুর্নীতি ও অনাচার প্রবেশ করায় এর শক্তিই যে শুধু বিনষ্ট হয়েছিল তা নয় , জনসাধারণের মনে বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে এক গভীর প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকূল মনোভাব সঞ্চার হয় , এই দুর্নীতির অন্যতম কারণ ছিল অর্থের প্রাচুর্য ও রাজানুগ্রহলাভ। 


ধর্মীয় নির্যাতন :- 
বৌদ্ধদের ওপর ধর্মীয় অত্যাচারের বেশকিছু প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বৌদ্ধদের উপর অত্যাচারের মূলে ধর্মের প্রভাব কতখানি ছিল সে বিষয়ে বৌদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞ রিজ ডেভিডস সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ডেভিডস এর মতে একমাত্র হুনরাজ মিহিরকুলের আমলেই বৌদ্ধদের ওপর ধর্মীয় অত্যাচার চলেছিল। '' দিব্যবদন '' নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে , হিন্দু নৃপতিদের মধ্যে পুষ্যমিত্র শুঙ্গই  সর্বপ্রথম বৌদ্ধদের নানাভাবে উৎপীড়িত করেছিলেন। পুরাণ অনুসারে পুষ্যমিত্র মৌর্য রাজবংশের অবসান ঘটিয়ে শুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরম পৃষ্ঠপোষক। তিব্বতীয় গ্রন্থকার তারানাথ পুষ্যমিত্রকে ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করেছেন। পুষ্যমিত্র অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন এর প্রমাণ আছে। সুতরাং দিব্যবদন ও তারানাথের রচনা অনুসারে এ কথা বলা যায় যে , বৌদ্ধধর্মের প্রতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের মনোভাব ছিল বিদ্বেষপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে অনুমান করা যায় যে , পুষ্যমিত্রের বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী মনোভাবের মূলে ছিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মৌর্য রাজবংশের উৎখাত করে পুষ্যমিত্রই হিন্দু রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পর খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধ ধর্মের ওপর আঘাত : মিহিরকুল :- 
পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পর বহু শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধদের ওপর ধর্মীয় অত্যাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  কুষাণদের আমলে বৌদ্ধধর্ম পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। গুপ্ত সম্রাটরা  ধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শ অনুসরণ করেন এবং তাদের আমলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে ধর্মান্ধ হূনরাজ মিহিরকুলের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বহু বৌদ্ধকে হত্যা করেন। 
হিউয়েন সাং ও রাজতরঙ্গিনী থেকে মিহিরকুলের বৌদ্ধ বিদ্বেষের বিবরণ পাওয়া যায়। অন্যান্য চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায় যে , খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু চিনে আগমন করেন। 


বাংলায় বৌদ্ধবিদ্বেষ :- 
বাংলা রাজা শশাঙ্ককেও বৌদ্ধ বিদ্বেষী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হিউয়েন সাং এর মতে , শশাঙ্ক অগণিত বৌদ্ধকে হত্যা করেন এবং বুদ্ধগয়ায় পবিত্র বোধিবৃক্ষটি উচ্ছেদ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে হিউয়েন  সাং এর বিবরণী থেকে জানা যায় যে , শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণতে বৌদ্ধদের প্রতিপত্তি ছিল। তবে শশাঙ্ক বৌদ্ধ বিদ্বেষী হলেও তিনি কতটা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আঘাত হেনেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। তা ছাড়া শশাঙ্ক প্রসঙ্গে হিউয়েন সাং এর বিবরণীকেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক অতিরঞ্জিত বলে মনে করেছেন। 

ইসলামের আবির্ভাব ও আক্রমণ :- 
স্মিথ এর মতে , মুসলমান আক্রমণকারীরা বৌদ্ধধর্মের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে মুসলমানদের ভারত আক্রমণ , বৌদ্ধ মঠগুলির ধ্বংসসাধন ও অসংখ্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ - ইত্যাদির ফলে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্তির পথে এগোতে থাকে।  স্মিথের ভাষায় , উত্তর ভারতের শেষ আশ্রয় বিহারে একজন ভাগ্যাম্মেষী মুসলমানের তরবারির আঘাতে সুগঠিত বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস হয়ে যায়। 
মুসলমানেরা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে অবশিষ্ট বৌদ্ধরা তাদের ধর্মগ্রন্থগুলি নিয়ে নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করে। অবশেষে ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেব ও শঙ্করদেবের নেতৃত্বে বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে বৌদ্ধধর্ম হিন্দু ধর্মের সঙ্গে প্রায় মিশে যায়। 

You May Also Like

0 comments