যোগের চারটি ধারা বা স্রোত : The Streams of Yoga

by - July 09, 2021

যোগের ধারা বা স্রোত :-  যোগের চারটি ধারা বা স্রোত : কর্মযোগ , ভক্তিযোগ , রাজযোগ , জ্ঞানযোগ। 




মানুষের ব্যক্তিত্বকে চারটি মৌলিক শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা সক্রিয় (কর্মযোগ) ,  মানসিক (ভক্তিযোগ) ,  ঐচ্ছিক ইচ্ছাকৃত (রাজযোগ ) , এবং স্বজ্ঞাত ( জ্ঞানযোগ ) । পতঞ্জলি এই সত্য পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে প্রত্যেক মানুষ এই শ্রেণীবিভাগের এক বা একাধিক প্রাধান্য অনুযায়ী বিভিন্ন মেজাজ ও চিত্তবৃত্তির হয়ে থাকে। 


এখানে যোগ এর চারটি প্রধান পথের কথা বলা হয়েছে ; যথা - কর্মযোগ , ভক্তিযোগ , রাজযোগ এবং জ্ঞানযোগ। প্রতিটি ভাগ একটি ভিন্ন মেজাজ বা জীবন পদ্ধতির উপযুক্ত হয়। কিন্তু সকল পথের গন্তব্যস্থল একই হয় , সেটা হল ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়া। 

স্বামী শিবানন্দ বলেছেন যে , প্রত্যেক যোগী বা মানুষের মধ্যে বুদ্ধি , হৃদয় , শরীর ও মন বর্তমান। কিন্তু সেইসকল বিষয়বস্তুর শনাক্তকরণ এবং অধিকারী হতে হবে। তিনি তাই প্রত্যেক পথ থেকে নির্দিষ্ট কৌশল অনুশীলন করতে বলেছিলেন। এটি সমন্বয়ের যোগ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি শিখিয়েছিলেন যে , ব্যক্তির মানসিক ও দৈহিক প্রকৃতি এবং রুচিবোধের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট যোগের  অভ্যাস করা উচিত। 

কর্মযোগ বলতে বোঝায় একটি কর্ম বা ধ্যানমগ্ন সচেতনতাসম্পন্ন অভ্যন্তরীণ মনোভাবের সঙ্গে সঠিক উপায়ে সঞ্চালিত হয়। এই কর্মযোগ অভ্যাসের অনেক সুবিধা আছে। এটি অধিক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য আমাদের একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। এটি একটি ধারালো পর্যবেক্ষণ যা চিন্তার প্রতিক্রিয়াশীল নিদর্শন উপলব্ধি করতে আমাদেরকে সাহায্য করে এবং এটি আমাদের সচেতনতা প্রসারের গভীরতম দিক যার সাহায্যে আমরা নির্দিষ্ট কর্ম কী এবং কীভাবে করতে হবে তার একটি পরিষ্কার চিত্র পাই।  এটি অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করি বা আবেগ ছাড়া কাজ করতে শিখি। এই দক্ষতা আমাদের ভালো সিদ্ধান্তকারী তৈরি করতে সহায়তা করে। 

কর্মযোগ এর আরেকটি নীতি হল সেবা , যেখানে আমাদের কর্মগুলি অন্যদের সুবিধা প্রদান করে। এটি ভগবৎ গীতায় নিষ্কাম কর্মফল বা নিঃস্বার্থ সেবা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবৎ গীতা অনুসারে কর্মযোগ  হল অভ্যন্তরীণ নিঃস্বার্থ ভক্তি , সেইসঙ্গে বাইরের ক্রিয়া-কলাপ এর আত্মাহুতি হিসাবে সর্ব কাজের পালনকর্তা। সমস্ত আত্মার কর্মশক্তি এবং তপস্যার অনন্ত নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে অর্পিত। কর্মযোগীরা তাদের সব কার্যকলাপ উচ্চক্ষমতা বা ভগবানের কাছে সমর্পণ করে থাকেন। এর ফলে তাকে চাপ এবং উদ্বেগ থেকে মুক্ত করে এবং তাকে সাফল্য বা ব্যর্থতা প্রশংসা বা সমালোচনার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে কর্মযোগ। পরিশেষে , কর্মযোগী একটি স্থায়ী মনের অবস্থা অজয় রাখতে পারেন এবং তীব্র কর্মের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন। 


২. ভক্তিযোগ :- 

এই পথ বিশেষ করে যাদের প্রক্ষোভ বা আবেগমূলক আচরণ দেখা যায় , তাদের জন্য। ভক্তিযোগী  ভালোবাসা বা প্রেমের শক্তিতে প্রধানত অনুপ্রেরণা পায় এবং ভালোবাসা বা প্রেমের প্রতিমূর্তি হিসাবে ভগবান বা ঈশ্বরকে দেখে থাকেন। প্রার্থনা , পূজা এবং আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করে থাকেন। ধারাবাহিকভাবে এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা' ও ভক্তি তার আবেগকে উত্তেজিত করে। ভক্তিযোগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল ঈশ্বরের প্রশস্তিমূলক গান বা ভজনগীত করা। 

ভক্তি শব্দের অর্থ হল - প্রেম , পূজা-উপাসনা করা এবং পরিবেশন করা। এছাড়াও ভক্তিযোগকে আবেগ মূলক সংস্কৃতির পদ বলা হয়। কারণ এটি আমাদের মধ্যে সহানুভূতি , নিষ্ঠা ও সেবার গুণাবলী বিকশিত করে। এটি আমাদের ভক্তিমূলক পথের মাধ্যমে আমাদের মানসিক বা আবেগমূলক জীবনীশক্তি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। 

ভক্তিযোগের নয়টি পদ্ধতি আছে সেগুলি হল - শ্রবণ , কীর্তন , স্মরণ , পদসেবন , অর্চনা , বন্দনা , দাস্য ,  সখ্যতা ও আত্মনিবেদন।  ভক্তিযোগ হল আধ্যাত্বিক ভক্তি ও আত্মসমর্পণের পথ। একজন ভক্তিযোগী  মনে করেন ভগবান সব কিছু দেখতে পান। ভগবানের ব্যাপ্তিশীল অস্তিত্বের বিষয় যা সচেতনভাবে হৃদয়ঙ্গম বা উপলব্ধি করা যায়। এই পথ আমাদের যন্ত্রণা এবং দুঃখ কমাতে ; বিশেষত ঈর্ষা , রাগ , ঘৃণা ,  যৌনক্ষুধা , অহংকার ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ দমনে সাহায্য করে। এটি আনন্দ , শান্তি , মানসিক প্রশান্তি ইত্যাদি ইতিবাচক আবেগ প্রকাশ করতে শেখায়। 

রাজযোগের প্রবর্তক ঋষি পতঞ্জলি। রাজযোগের বিস্তৃত বিবরণ আছে পতঞ্জলি যোগদর্শনে। বাংলা ভাষায় এর ব্যাখ্যা করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। রাজযোগে শুরু থেকে আত্মউপলব্ধির অতিচেতন অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য আটটি মার্গ বা পর্যায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

(i) ইয়ম হল রাজযোগের প্রথম মার্গ বা পর্যায়। মানুষের মনের চঞ্চলতার মূল কারণ হলো আশা-আকাঙ্ক্ষা। ইয়ম হল এই আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণের উপায়। এর জন্য পাঁচটি পথ অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল - অহিংসা , সততা , অচৌর্য ,ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ। 

(ii) রাজযোগের দ্বিতীয় পর্যায় হলো নিয়ম। নিয়ম হলো ব্যক্তি জীবনে অনুসরণযোগ্য পাঁচটি নির্দেশ।  এগুলি হল - পরিছন্নতা , সন্তোষ , তপস্যা , শাস্ত্রপাঠ এবং ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। 

(iii) রাজযোগের তৃতীয় পর্যায় হলো আসন বা বসার ভঙ্গি। যোগাসনের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন মেরুদন্ড সোজা করে স্বাধীনভাবে ধরে রাখার সক্ষমতা। মাথা , ঘাড় ও বুক এক সরলরেখায় সন্নিবিষ্ট রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের আসনের অনুশীলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

(iv) রাজযোগের চতুর্থ পর্যায় হলো প্রাণায়াম .আক্ষরিক অর্থে প্রাণায়াম হলো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেহের মধ্যে প্রাণের নিয়ন্ত্রণ .প্রাণায়াম এর তিনটি মূল অংশ হল - পূরক , কুম্ভক এবং রেচক।নাসারন্ধ্র দিয়ে বাতাস টেনে নেওয়াকে বলা হয় পূরক , শ্বাস নেওয়ার পর নাসারন্ধ্র বন্ধ করে ভিতরে বাতাস আবদ্ধ রাখাকে কুম্ভক এবং নাসারন্ধ্র দিয়ে ধীরে ধীরে বাতাস ছাড়াকে বলা হয় রেচক। 

(v) রাজযোগের পঞ্চম পর্যায় হলো প্রত্যাহার। আত্মোপলব্ধির জন্য কর্মচঞ্চলতা অনভিপ্রেত। তাই তা বন্ধ করা প্রয়োজন। ইন্দ্রিয় কেন্দ্রের সঙ্গে মনকে যুক্ত করাকে প্রত্যাহার বলে। এই সময় ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে ব্যক্তি বাইরের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের মধ্যে আত্মিক শক্তি উপলব্ধির জন্য তৈরি হয়। 

(vi) প্রত্যাহারের পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ রাজযোগের ষষ্ঠ পর্যায় হলো ধারণা। মনকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে অবিচলভাবে ধরে রাখাকেই ধারণা বলে। এই সময় দেহের অন্যান্য অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটি অংশকে অনুভব করা হয়। এজন্য যোগীরা মেরুদন্ডের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন প্রকার জ্যোতির্ময় পদ্মের কল্পনা করে থাকেন। 

(vii) রাজযোগের সপ্তম পর্যায়ে হলো ধ্যান। ধারণা দীর্ঘায়িত হলে তখন তাকে ধ্যান বলে। এই অবস্থায়  একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একাগ্রচিত্ত মনের শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। 

(viii) রাজযোগের পরবর্তী বা সর্বশেষ পর্যায় হলো সমাধি। মন ও দেহাভ্যন্তরস্থ স্নায়বিক গতি ও মানসিক প্রতিক্রিয়া উপলব্ধিতে মগ্ন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মানুষের মন জ্ঞানতীত চেতনার স্তরে পৌঁছায়। তখন একে বলে সমাধি। আত্মশক্তির উপলব্ধিতে মানুষ মহাজ্ঞানী হয়ে ওঠে। 

জ্ঞানযোগ সবচেয়ে কঠিন পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির ক্ষেত্রে প্রয়োজন ইচ্ছা ও বুদ্ধির অসাধারণ শক্তির। ধর্মগ্রন্থ ও বেদান্তের শিক্ষার মাধ্যমে , মানুষ তার নিজস্ব প্রকৃতি অনুসন্ধানের জন্য তাদের মনকে ব্যবহার করে। এছাড়া এটির আত্মজ্ঞানের যোগ এবং তার নিজস্ব পদ্ধতি আছে। নিজের সামর্থ্য অনুসারে , লাভ-লোকসানের নির্ণয় করে এই কর্মে প্রবৃত্ত হওয়াই হল জ্ঞানযোগ। এই মার্গের  সাধক জানেন যে , ''আজ আমারে এই স্থিতি , এরপরে এই ভূমিকায় পৌঁছাব এবং তারপর স্বরূপ লাভ করব। '' 
এইরূপ ভাব নিয়ে জ্ঞানযোগী কর্মে প্রবৃত্ত হন। তিনি নিজে তার স্থিতি অবগত হয়ে চলেন।  সেই জন্যই এঁদের জ্ঞানমার্গী বলা হয়। 
শোনার পদ্ধতিকে বলা হয় শ্রবণ ,  স্মরণ করা এবং বিশ্লেষণকে বলা হয় মনন এবং বাস ধ্যানকে বলে নিদিধ্যাসনা। বিজ্ঞানের যুগে মানুষ একটি বিচক্ষণ বা জ্ঞানী ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছেন। বুদ্ধিজীবী ব্যক্তির প্রখরতা আসন্ন। দর্শনের পথ প্রখর বুদ্ধিজীবীদের জন্য উপযুক্ত বা যথাযথ হয় এবং সুখের বিশ্লেষণের উপর কেন্দ্রীভূত হয় , এক্ষেত্রে উপনিষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।  

গভীর চিন্তা সেই সত্যের উপর শুরু হয় যা বর্ণনা করা হয়েছে এবং যা যৌক্তিকভাবে গৃহীত হয়েছে , এটিই হল সাধনা বা গভীর ধ্যান। এটিই হল জ্ঞানযোগের গভীর চিন্তা। আমরা ধ্যানের মাধ্যমে মনের গভীরে প্রবেশ করে উচ্চ এবং উচ্চতর মাত্রার জট খুলে সমাধান করতে পারি। এটি হলো জ্ঞান বা উপলব্ধি। অনুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জ্ঞানযোগ আমাদের ভিতরে প্রকৃতির কাছে নিয়ে আসে এবং এর ফলে উদ্দীপ্ত জ্ঞান এবং প্রসারিত সচেতনতার জাগরণ ঘটে। 

You May Also Like

0 comments