বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার শর্তগুলি আলোচনা কর।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার শর্তগুলি আলোচনা কর।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার শর্ত:-
বিচারবিভাগ হল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষাকর্তা। বিচারবিভাগ সরকারের স্বৈরাচারী মানসিকতা প্রতিহত করে , জনস্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়নে বাধা প্রদান করে বা বাতিল করে দেয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। তাই বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য। বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন -
১. ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ :-
সরকারের মূল তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার। রাষ্ট্রীয় নীতিতে ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি গৃহীত হলে অপর দুই বিভাগ বিভাগকে কম প্রভাবিত করতে পারে বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারায়। শাসন বা আইন বিভাগ যদি খুব সহজেই বিচারপতিদের পদচ্যুত করতে পারে , তাহলে বিচার প্রক্রিয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসরণ করা একান্তভাবে কাম্য।
২. বিচারপতিদের যোগ্যতা :-
পেশাগত যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতিদের আরো বেশ কিছু মানবিক ও সামাজিক যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। এইসকল যোগ্যতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - সততা , নির্ভীকতা , যুক্তিবাদিতা , রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা - ইত্যাদি। এছাড়াও বিচারপতিদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
৩. বিচারপতিদের নিয়োগ :-
বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন - ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র - ইত্যাদি দেশে উচ্চ আদালতগুলির বিচারপতিগণ শাসনবিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত হন। এক্ষেত্রে , বিচারপতিদের সম্পূর্ণরূপে শাসন বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখা অনেকসময় সম্ভব হয়না।
আবার , সুইজারল্যান্ড , বুলগেরিয়া - ইত্যাদি দেশে বিচারপতিগণ আইনসভা কর্তৃক নিযুক্ত হন। ফলে বিচারপতিদের নিয়োগ ও কার্যকাল নির্ভর করে আইনবিভাগের সদস্যদের ইচ্ছা - অনিচ্ছার উপর।
অন্যদিকে , বিচারকগণ যদি জনগণ কর্তৃক নিযুক্ত হন - তাহলেও বিচারকদের পক্ষে পক্ষপাতহীন বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হয়না।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন , এখনও পর্যন্ত কোনো বিচারবিভাগেই বিচারপতি নিয়োগের সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি।
৪. বিচারপতিদের কার্যকাল :-
বিচারপতিরা স্বল্প সময়ের জন্য নিযুক্ত হলে তাদের মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠবার সম্ভাবনা দেখা যায় এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। তাই বিচারপতিদের কার্যকাল একটি নির্দিষ্ট বয়স বা সময়কাল পর্যন্ত থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
৫. বিচারপতিদের অপসারণ :-
বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নটির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সাধারণতঃ আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের হাতে উচ্চ পদস্থ বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টির দায়ভার অর্পিত থাকে। কিন্তু বিচারপতিদের পদচ্যুত করার ক্ষেত্রে আইন বা শাসনবিভাগের যদি কোনো সংকীর্ণ স্বার্থ জড়িত থাকে - তাহলে তা বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়। তাই বেশিরভাগ শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র অযোগ্যতা , দুর্নীতি , সাংবিধানিক অধিকারভঙ্গ - ইত্যাদি সংবেদনশীল অভিযোগ ছাড়া বিচারপতিদের পদচ্যুত করা যায়না।
৬. বিচারপতিদের বেতন সংক্রান্ত বিষয় :-
প্রতিটি বিচারালয়ের বিচারপতিদের বেতন , ভাতা - ইত্যাদি পদাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থির করা উচিত। বিচারপতিদের বেতন যদি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না হয় তাহলে বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাবনা দেখা দেয় ; যেমন -
(ক ) বিচারপতিদের মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
(খ ) যোগ্য ব্যক্তিরা বিচারপতির পদ গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন।
(গ ) বিচারপতিরা পদে থাকাকালীন অন্য বৃত্তি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে পারেন - যা বিচারব্যবস্থার মর্যাদার পক্ষে মোটেও শোভনীয় নয়।
৭. চাকুরী সংক্রান্ত নিরাপত্তাবিধান :-
বিচারকদের চাকুরী সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্ত , পদের স্থায়িত্ব ও কার্যকাল - ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলে বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করতে পারেন।
৮. সামাজিক নিরাপত্তাবিধান :-
নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে বিচারপতিদের অনেকসময় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী , সমাজবিরোধী , রাজনৈতিক নেতা , সমাজবিরোধী - ইত্যাদির বিরুদ্ধে রায় প্রদান করতে হয় ও শাস্তির বিধান দিতে হয়। তাই বিচারপতিদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্ছিদ্র হওয়া উচিত যাতে তারা কোনোপ্রকার হুমকি বা ভীতিপ্রদর্শনের সম্মুখীন না হন।
৯. এছাড়াও বিচারপতিদের জনমতের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। বিচারকার্যে জনমতের প্রভাব নিরপেক্ষ বিচারের পক্ষে কাম্য নয়।
পরিশেষে বলা যায় , বিচারবিভাগের স্বাধীনতা বহুলাংশে নির্ভর করে বিচারপতিদের ব্যাক্তিগত চরিত্র ও ব্যক্তিত্ত্বের উপর। কেননা , আইন বিভাগ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাসনবিভাগ সংকীর্ণ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে বিচারবিভাগকে প্রভাবিত করতে চায়। তাই বিচারব্যবস্থার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা সম্ভব নয়। অ্যালান বল বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টিকে আধা অলীক কাহিনী ( Semi - Fiction ) বলে অভিহিত করেছেন।
0 comments