মেটারনিখ ব্যবস্থা কাকে বলে ? মিটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
মেটারনিখ ব্যবস্থা কাকে বলে ? মিটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
মেটারনিখ ব্যবস্থা :-
ইউরোপের ইতিহাসে ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত সময়কাল যাবৎ ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ। তাই ইউরোপের ইতিহাসে এই সময়কালকে '' মেটারনিকের যুগ '' বলে। এই সময়কাল যাবৎ মেটারনিখ সমগ্র ইউরোপ রক্ষণশীল ও পুরাতনপন্থী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। মেটারনিখ প্রবর্তিত এই শাসন ব্যবস্থা '' মেটারনিখ ব্যবস্থা '' বা '' মেটারনিখতন্ত্র '' নামে পরিচিত। মেটারনিকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রতিরোধ করা এবং পুরাতনতন্ত্রের প্রচলন ঘটানো।
মেটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট :-
১. বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রতিরোধ :-
মেটারনিখ ছিলেন রাজতান্ত্রিক ভাবধারার সমর্থক। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যে বৈপ্লবিক ভাবধারা জন্ম নিয়েছিল - মেটারকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেই বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রতিরোধ করা। ফরাসি বিপ্লব হতে উদ্ভুত স্বাধীনতা , সাম্য , উদারনীতি , সৌভাতৃত্ব - ইত্যাদি আদর্শগুলিকে মেটারনিখ রাজনৈতিকভাবে তীব্র বিরোধিতা করতেন। তাই এই ধরণের ভাবধারা প্রতিরোধ করতে মেটারনিখ বদ্ধপরিকর ছিলেন।
২. রক্ষনশীলতা :-
ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে যেসকল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল সেই সকল পরিবর্তনগুলির তীব্র বিরোধিতা করেন মেটারনিখ। তিনি রক্ষণশীল আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই মেটারনিকের শাসনকালে ফরাসি বিপ্লব হতে উদ্ভুত সকল প্রকার প্রগতিশীল পরিবর্তনকে তিনি নস্যাৎ করে দেন।
৩. পুরাতনতন্ত্র :-
মেটারনিকের শাসনকালে ইউরোপ বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যায়। পুরোনো সকল রাজবংশগুলিকে ইউরোপের বিভিন্ন সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। যেমন নেপোলিয়নের পর ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবোঁ বংশের অষ্টাদশ লুই। এমনকী , সংবাদপত্রেও যাতে প্রগতিশীল ও আধুনিক ভাবধারার প্রচার না করা হয় - সে বিষয়ে কঠোর দৃষ্টি রাখা হত।
৪. ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা :-
মেটারনিখ তাঁর সময়কালে ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য ও একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন পরিস্থিতিতে ফ্রান্স , হল্যান্ড , প্রাশিয়া - ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলি অনেকটা শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী কোনো নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেনি। মেটারনিখ এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রিয়াকে ইউরোপের নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
৫. ইউরোপের পুনর্গঠন ও শক্তিসাম্য রক্ষা :-
ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে সমতা বজায় রাখতে মেটারনিখ বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয় , ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী তিনটি জেলা সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয় , স্যাভয় ও সার্ডিনিয়ার সঙ্গে জেনোয়াকে যুক্ত করা হয় প্রাশিয়ার সঙ্গে রাইন অঞ্চলের জেলাগুলিকে যুক্ত করা হয় - ইত্যাদি।
৬. ফ্রান্সকে দুর্বল করে তোলা :-
যেহেতু বৈপ্লবিক ভাবধারাগুলির জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সে , তাই মেটারনিখ ফ্রান্সকে যতটা সম্ভব দুর্বল করে তুলতে চেয়েছিলেন - যাতে ফ্রান্সে নতুন করে কোনো বৈপ্লবিক ভাবধারার প্রসার ঘটে অস্ট্রিয়ার নেতৃত্ব বিপন্ন না করতে পারে। এই উদ্দেশ্যে মেটারনিখ বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে সেখানে পাঁচ বছরের জন্য মিত্রপক্ষের সেনা নিয়োগ করা হয় , ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ৭৫ কোটি ফ্রাঁ ফ্রান্সের কাছ থেকে আদায় করা হয় , ফ্রান্সের সীমানা পুনর্গঠন করা হয় - ইত্যাদি।
৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নীতি :-
মেটারনিখ একদিকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ও রক্ষনশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ; এবং অন্যদিকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি।
৮. কার্লসবাড ডিক্রি :-
মেটারনিখ উদারনৈতিক ভাবধারাকে স্বমূলে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বৌদ্ধিক জগতে বৈপ্লবিক ভাবধারার প্রসার প্রতিরোধ করতে না পারলে শীঘ্রই তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই উদ্দেশ্যে মেটারনিখ কার্লসবাড ডিক্রি জারি করেন। এই নির্দেশনামার মাধ্যমে ছাত্র , শিক্ষক , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান - সকলকেই উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল ভাবধারা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
৯. রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ :-
নেপোলিয়ন পরবর্তী যুগে ভিয়েনা সম্মেলনের পর ইউরোপে যেসকল রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় - সেগুলি সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেটারনিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। মেটারনিখ এইসকল রাজবংশগুলির উপর নিজ রক্ষণশীল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি রাজবংশগুলিকে নির্দেশ দিতেন - শাসন করুন , কিন্তু পরিবর্তন করবেন না ( Govern but change nothing ) ।
১০. অস্ট্রিয়াতে একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা :-
ভিয়েনা সম্মেলনের পর অস্ট্রিয়াতে মেটারনিকের একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি অস্ট্রিয়ার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈপ্লবিক আদর্শ প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে - দর্শন , নীতিশাস্ত্র , যুক্তিবিদ্যা - ইত্যাদি প্রগতিশীল বিষয়গুলি পঠন - পাঠন বন্ধের নির্দেশ দেন। এমনকী , তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি'না তার উপর নজর রাখার জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন।
পরিশেষে বলা যায় , ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপীয় রাজনীতিতে মেটারনিকের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকলেও , মেটারনিকের নীতিগুলির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল - তার পতনের কারণ। কেননা , মেটারনিকের প্রতিটি সিদ্ধান্ত বলপূর্বক ইউরোপীয় শক্তিবর্গের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ; তাতে জনসমর্থনের লেশমাত্র ছিলনা।
0 comments