­
মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণ। - NANDAN DUTTA

মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণ।

by - April 17, 2025

মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণ।  




মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণ :- 


নেপোলিয়নের পতনের পর ভিয়েনা সম্মেলন ও তার পরবর্তী সময়কালে ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সম্মেলন থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পর্যন্ত সময়কালকে তাই '' মেটারনিকের যুগ '' বলা হয়। এই সময়কালে মেটারনিখ সমগ্র ইউরোপ জুড়ে প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল , উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল ভাবধারার বিরোধী এবং রক্ষণশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থাকে '' মেটারনিখ ব্যবস্থা '' বলা হয়। তবে মেটারনিকের বিভিন্ন নীতির মধ্যেই তাঁর পতনের বীজ নিহিত ছিল। মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণগুলি ছিল - 

১. বিপ্লব বিরোধিতা :- 
মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লব হতে উদ্ভুত সকল প্রকার প্রগতিশীল ভাবধারার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি বলপ্রয়োগ ও দমনমূলক নীতির মাধ্যমে সকল প্রকার আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবধারার প্রসার রোধ করেছিলেন। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব থেকে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন প্রগতিশীল আদর্শগুলি মানুষকে প্রগতিশীলতার পথে ভাবতে শিখিয়েছিল। তাই মাত্র তিন দশক মেটারনিখ বলপ্রয়োগ করে সেগুলির প্রসার রোধ করলেও তা একসময় মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

২. রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা :- 
ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে মেটারনিখ ইউরোপে পুরোনো বিভিন্ন রাজবংশগুলিকে ইউরোপের বিভিন্ন সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। যেমন - ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবোঁ রাজবংশের অষ্টাদশ লুইকে বসানো হয়। কিন্তু ফরাসি বিপবের ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও বিরোধিতা জন্ম নিয়েছিল মেটারনিকের নীতি সেই ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে তোলে। মূলতঃ এর ফলেই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লব ও ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংগঠিত হয়। 


৩. পরিবর্তনের বিরোধী :- 
মেটারনিখ তীব্রভাবে রক্ষণশীল ছিলেন এবং যেকোনো পরিবর্তনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এই রক্ষণশীল নীতির জন্য ইউরোপ সমগ্র বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। ফলে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এছাড়াও পরিবর্তনের বিরোধিতার ফলে ইউরোপ অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক - ইত্যাদি সব দিক দিয়েই পিছিয়ে পড়েছিল। 

৪. শিল্পবিপ্লব :- 
ইতিমধ্যেই ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয়। শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ড , জার্মানি - ইত্যাদি রাষ্ট্রকে প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। এছাড়া শিল্প বিপ্লবের ফলে যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল - মেটারনিখ তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে না পেরে চূড়ান্ত ভুল করেছিলেন। 

৫. ইউরোপীয় অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির বিরোধিতা :- 
মেটারনিখের নীতি ইউরোপের প্রগতিশীলতা রুদ্ধ করে দেওয়ায় ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলি মেটারনিখ ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে থাকে। যেমন , সর্বপ্রথম ইংল্যান্ড ও রাশিয়া মেটারনিখ নীতি ত্যাগ করে এবং তার পরবর্তীকালে ফ্রান্সও মেটারনিখ নীতি ত্যাগ করে। ফলে অস্ট্রিয়া ও মেটারনিখ ব্যবস্থা উভয়ই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। 

৬. অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি :- 
মেটারনিকের নীতিগুলি ছিল সময়ের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। একদিকে ফরাসি বিপ্লব সাধারণ মানুষ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে গতিশীল মতাদর্শের জন্ম দিয়েছিল ; অন্যদিকে শিল্প বিপ্লব , নগরায়ণ - ইত্যাদি বিষয়গুলি ইউরোপে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। কিন্তু সেখানে মেটারনিকের প্রগতিশীল বিরোধী নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। 


৭. শিক্ষা ক্ষেত্রে কঠোর নীতি প্রয়োগ :- 
রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে মেটারনিখ শিক্ষা ক্ষেত্রগুলিকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে দর্শন , নীতিশাস্ত্র - ইত্যাদি প্রগতিশীল বিষয়গুলির পঠন - পাঠন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কোনোভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাতে প্রগতিশীল ভাবধারা প্রচার না করা হয় সেজন্য তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব মানুষের বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে যে প্রগতিশীল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল - তার গতি রুদ্ধ করা মেটারনিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

৮. জনসমর্থনের অভাব :- 
মেটারনিকের সকল নীতি ও কর্মসূচি ইউরোপীয় সাধারণ মানুষ ও রাজন্যবর্গের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই আরোপিত কূটনৈতিক ব্যাবস্থা সাধারণ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গও খোলামনে স্বীকার করেননি। তাই মেটারনিখ ব্যবস্থা কোনো স্তরেই জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি - যা ছিল তার পতনের অন্যতম কারণ। 

৯. বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান :- 
মেটারনিখ ব্যবস্থার উপর তীব্র আঘাত হানে ইউরোপের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান। যেমন - মেটারনিখ ব্যবহার বিরুদ্ধে ফার্দিনান্ড নিজ রাজ্যে প্রগতিশীল শাসন ব্যবস্থা চালু করেন ; এমনকি পর্তুগালে মেটারনিকের নীতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত হয়। এছাড়াও নেপলসে আধুনিক ভাবধারার প্রসারের ফলে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এইসকল জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান মেটারনিখ তন্ত্রের পতনকে নিশ্চিত করে তোলে। 

১০. ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮) ও মেটারনিখ ব্যবস্থার পতন :- 
১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্রান্সে ''দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র '' প্রতিষ্ঠিত হয়। জুলাই বিপ্লবের মূল কারণ ছিল - শাসন ব্যবস্থায় বুর্জোয়াদের প্রাধান্য , ত্রুটিপূর্ণ বিদেশনীতি , মূল্যবৃদ্ধি , বেকার সমস্যা , বাণিজ্যিক মন্দা - ইত্যাদি। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে লুই ফিলিপ অস্ট্রিয়ার সিংহাসন হারালেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল মেটারনিকের পতন। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে তীব্র ছাত্র ও শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের আন্দোলন শুরু হলে তা ধীরে ধীরে সমগ্র অস্ট্রিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। এইসময় পুলিশের গুলিতে ২৩ জন নিহত হলে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং সমগ্র ইউরোপ উত্তাল হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে মেটারনিখ এবং লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মেটারনিখ ব্যবস্থার পতন ঘটে।     

You May Also Like

0 comments