জুলাই বিপ্লবের ফলাফল।
জুলাই বিপ্লবের ফলাফল।
জুলাই বিপ্লবের ফলাফল।
ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপের ইতিহাসে ১৮৩০ এর জুলাই বিপ্লব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। জুলাই বিপবের মাধ্যমেই ফ্রান্সে বহুদিনের বুরবোঁ শাসনের অবসান ঘটে তথা ফ্রান্সের সিংহাসনে বংশানুক্রমিক রাজপদ অধিকারের যে প্রথা প্রচলিত ছিল তা বিলুপ্ত হয়।
তবে ডক্টর রবিনসন ও বিয়ার্ড জুলাই বিপ্লবকে কোনো যুগান্তকারী ঘটনা বা বিপ্লব বলতে রাজি নন। তাঁদের মতে , জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স তথা ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছিল খুব সামান্য ; তাই একে বিপ্লব আখ্যা দেওয়া উচিত নয়। এছাড়াও ঐতিহাসিক কোব্বান জুলাই বিপ্লবকে একটি '' রক্ষণশীল বিপ্লব '' বলে অভিহিত করেছেন।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। কোনো নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হয়নি , প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি , মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ঐতিহাসিকগণের সিংহভাগ জুলাই বিপ্লবের ফলাফল হিসাবে শুধুমাত্র রাজবংশের পরিবর্তনকেই একমাত্র উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসাবে চিহ্নিত করেন।
যাইহোক জুলাই বিপবের ফলাফলকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
(ক ) ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব ও
(খ ) ইউরোপে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব।
(ক ) ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব :-
১. বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতন :-
নেপোলিয়নের পতনের পর ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে বুরবোঁ বংশীয় দশম চার্লস ফ্রান্সের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বুরবোঁ রাজবংশের শাসন ক্ষমতার অবসান ঘটে এবং অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসন দখল করেন। এছাড়াও বুরবোঁ রাজবংশের সকল প্রকার সাংবিধানিক ও বিশেষ ক্ষমতার অবসান ঘটে।
২. বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের অবসান :-
বুরবোঁ রাজবংশের পতনের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বংশানুক্রমিক রাজপদ অধিকারের প্রথাটিও বাতিল হয়ে যায়। বুরবোঁ রাজবংশ তার সকল ক্ষমতা হারিয়ে কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
৩. জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন :-
জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রথম প্রতিফলনের ঘটনা দেখা যায়। কেননা , লুই ফিলিপ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হলেও তিনি সাংবিধানিক বিধিনিয়ম অনুসারে রাজতন্ত্র পরিচালনার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তাই এই ঘটনাকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বলা যেতে পারে।
৪. বুর্জোয়াদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা :-
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগে বুর্জোয়াদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শাসন ক্ষমতা লাভ করে বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে। ফলে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় শ্রেণীর মানুষেরা অধিকার বঞ্চিত হন। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসন সম্পর্কে যে ক্ষোভ জন্ম নেয় - তা অনতিদূরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়।
৫. ভোটাধিকারের পরিবর্তন :-
অষ্টাদশ লুইয়ের শাসনকালে ন্যূনতম ৩০০ ফ্রাঁ কর প্রদানকারীদের কেবলনাত্র ভোটাধিকার ছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর লুই ফিলিপের আমলে ৩০০ ফ্রাঁ - এর পরিবর্তে ন্যূনতম ২০০ ফ্রাঁ কর প্রদানকারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে না হলেও তৎকালীন পরিস্থিতির সাপেক্ষে এটি ছিল বিপ্লবের একটি বড় জয়।
৬. সামন্ততন্ত্রের উপর তীব্র আঘাত :-
জুলাই বিপ্লবের সংস্কারগুলি ফ্রান্সে প্রচলিত সামন্ততন্ত্রের উপর তীব্র আঘাত হানে। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যেহেতু ফ্রান্সে উগ্র রাজপন্থীদের বিলোপ ঘটে ; তার ফল হিসাবে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্র দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়।
৭. যাজক শ্রেণীর ক্ষমতা হ্রাস :-
জুলাই বিপ্লবের পর ফ্রান্সে যাজক শ্রেণীর ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ইতিপূর্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও নীতি নির্ধারণ , শিক্ষা ব্যবস্থা , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যাজক শ্রেণীর যে প্রবল ক্ষমতা ছিল - তার অবসান ঘটে। এছাড়াও যাজক শ্রেণী যেসকল রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করেছিল - সেগুলি বাতিল করা হয়। স্বাধীন চিন্তা প্রসারের বিরুদ্ধে যাজক সম্প্রদায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে যে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করত - তার সম্ভাবনা দূর হয়।
৮. সাংবিধানিক পরিবর্তন :-
ইতিপূর্বে ফ্রান্সের সংবিধানের ১৪ নং ধারা অনুসারে জরুরি অবস্থায় রাজা অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর রাজার অর্ডিন্যান্স জারি করার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নেওয়া হয়। আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের প্রকৃত ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে অধিষ্ঠিত হয়।
৯. মেটারনিখ ব্যবস্থার অবসানের সূচনা :-
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসের পর অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল নীতি কার্যকর করেন। কিন্তু লুই ফিলিপের সিংহাসনারোহনের মাধ্যমে ভিয়েনা কংগ্রেসের '' ন্যায্য অধিকার নীতি '' অমান্য করা হয়। এইভাবে প্রাথমিকভাবে মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের সূচনা হয়।
১০. ফ্যাক্টরি আইন প্রবর্তন :-
শিল্পবিপ্লবের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর অর্থের সমাগম হলেও শ্রমিকরা ছিলেন শোষিত ও বঞ্চিত। শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সমাজতন্ত্রী লুই ব্ল্যাঙ্ক। তাঁদের তীব্র আন্দোলনের চাপে পড়ে লুই ফিলিপ সরকার ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে শ্রমিকদের স্বার্থে ফ্যাক্টরি আইন প্রবর্তন করতে বাধ্য হন।
(খ ) ইউরোপে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব :-
সমগ্র ইউরোপ জুড়ে জুলাই বিপ্লবের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। জুলাই বিপ্লবের পরও মেটারনিখ ইউরোপ জুড়ে রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্র বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অন্যদিকে লুই ফিলিপ ছিলেন সংস্কারের প্রতি উদাসীন ; তিনি স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল আদর্শগুলি জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।
১. পোল্যান্ডের বৃহদাংশ এতদিন পর্যন্ত রাশিয়ার অধীনে এবং কিছুটা প্রাশিয়ার অধীনে ছিল। জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ রাজবংশের পতন ঘটলে পোল্যান্ডেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়
২. ১৮১৫ সালে ভিয়েনা চুক্তির মাধ্যমে বেলজিয়ামের স্বাধীনতা লোপ পেয়েছিল। বেলজিয়ামকে ডাচ বা হল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বুরবোঁ রাজবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বেলজিয়ামে ডাচ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং ২৫ শে অগাস্ট ১৮৩০ সালে এক অভ্যত্থান ঘটে এবং ৪ঠা অক্টোবর বেলজিয়াম স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
৩. জার্মানিতেও কাসেল , লাইপজিগ , ব্রান্সউইক - ইত্যাদি অঞ্চলে উদারনৈতিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
৪. বুরবোঁ রাজবংশের অবসানের পর ইতালিতে কার্বনারী সহ অন্যান্য গুপ্তসমিতিগুলি অধিকমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বৈদেশিক শাসনের অবসানের দাবী জানাতে থাকে।
৫. এছাড়া , জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে প্রভাবিত হয়ে সুইজারল্যান্ড , সুইডেন ,পর্তুগাল - ইত্যাদি রাষ্ট্রেও উদারনৈতিক সংবিধানের দাবীতে আন্দোলন শুরু হয় এবং বেশ কিছু প্রগতিশীল পরিবর্তন সাধিত হয়।
৬. ইতিপূর্বে নরওয়ে সুইডেনের অধীনে ছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর নরওয়েতে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
৭. ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন ছিল মূলতঃ শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। চার্টারে শ্রমিক স্বার্থ সমন্বিত মোট ৬ টি দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
৮. স্পেন ও পর্তুগাল উভয় রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তনের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে , জুলাই বিপ্লব মানুষের আশা - আকাঙ্খাকে পূরণ করতে না পারলেও ফরাসি বিপ্লব থেকে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক ভাবধারা , প্রগতিশীলতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ - ইত্যাদি বৌদ্ধিক বিষয়গুলিকে পুনরায় জাগিয়ে তুলছিল। তাই জুলাই বিপ্লবের পরোক্ষ প্রভাব হিসাবে ১৮১৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের উত্থানকে চিহ্নিত করা হলে অত্যুক্তি করা হবেনা।
0 comments