জুলাই রাজতন্ত্র কাকে বলে ? জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।
জুলাই রাজতন্ত্র কাকে বলে ? জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।
জুলাই রাজতন্ত্র :-
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজা দশম চার্লস সিংহাসনচ্যুত হন এবং অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। লুই ফিলিপের রাজত্বকাল স্থায়ী ছিল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময়কাল পর্যন্ত। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। তাই তাঁর রাজত্বকালকে '' জুলাই রাজতন্ত্র '' বলা হয়।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুলাই থেকে পরবর্তী ১৮ বছর জুলাই রাজতন্ত্র বা লুই ফিলিপের শাসনকাল ফ্রান্স তথা ইউরোপের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কালে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় , সম্রাটের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা যুক্তিহীন ও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয় , ২৫ বছর বয়সী সকল নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় , আইন ও শাসন বিভাগে অভিজাত ও রাজার পরিবর্তে উচ্চ বুর্জোয়াদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় - ইত্যাদি।
তবে , ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে জুলাই রাজতন্ত্র ও লুই ফিলিপের পতন ঘটে।
জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের বিভিন্ন কারণগুলি হল -
১. লুই ফিলিপের জনপ্রিয়তা হ্রাস :-
জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফরাসি জনসাধারণের মধ্যে তীব্র আশা - আকাঙ্খা তৈরী হয়। কিন্তু লুই ফিলিপ ছিলেন জনসাধারণের সেই সকল আশা - আকাঙ্খার প্রতি তীব্রভাবে উদাসীন। বিপ্লব প্রসূত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোতে সেরূপ কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং পার্লামেন্টে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আদর্শগত সংঘাত - রাষ্ট্রের চলনশক্তি শ্লথ করে তুলেছিল। ফলে যে তীব্র জনপ্রিয়তা সিংহাসনারোহণকালে লুই ফিলিপ অর্জন করেছিলেন - মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়ে।
২. ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতি :-
অর্লিয়েন্স বংশের রাজত্বকাল অনেকটা নির্ভর করছিল দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতির উপর। কিন্তু লুই ফিলিপ সেরূপ কোনো দৃঢ় পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস ছিল বিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র। প্রগতিশীল ভাবধারা ইউরোপ জুড়ে যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার ফলে - বেলজিয়াম স্বাধীনতা ঘোষণা করে , পোল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে , জার্মানি ও ইতালিতেও গণ - আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু লুই ফিলিপের নিষ্ক্রিয়তা ও বিচ্ছিন্নতা ফ্রান্সের গতিশীলতা রুদ্ধ করে।
৩. অভ্যন্তরীণ নীতির ব্যর্থতা :-
ফরাসি জনসাধারণ লুই ফিলিপের অভ্যন্তরীণ নীতিগুলির প্রতিও বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। দুই মন্ত্রী - শেতোব্রিয়া (Chateaubriand) ও থিয়ার্স একের পর এক প্রতিক্রিয়াশীল নীতি প্রবর্তন করেন। এই সকল দমনমূলক নীতির ফলে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সঞ্চারিত হয়। কিন্তু জনগণের সেই অসন্তোষের প্রতি লুই ফিলিপ ছিলেন সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। তাই লুই ফিলিপের পররাষ্ট্র নীতির মত তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতিও ছিল সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।
৪. বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা :-
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগে অভিজাত সম্প্রদায় ও রাজার পরিবর্তে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় , লুই ফিলিপের সমগ্র রাজত্বকাল জুড়ে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষমতা ছিল বুর্জোয়াদের হাতে। এই বুর্জোয়া শ্রেণী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ফ্রান্সের প্রগতি ও জনকল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র কৃষক , শ্রমিক ও অন্যান্য তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি প্রবর্তন করে। ফলে দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়।
৫. ভোটাধিকার সংক্রান্ত বিরোধ :-
জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ২৫ বছর বয়সী সকল নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু শীঘ্রই সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী বুর্জোয়া সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকারের নীতি প্রবর্তন করেন। ফলে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
৬. বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শগত সংঘাত :-
জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্লিয়েন্স বংশের রাজতান্ত্রিক শাসনের সূচনা ঘটলেও লুই ফিলিপের প্রতি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল না। রাজনৈতিক দল ও রাজতন্ত্রের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত ছিল তীব্র। যেমন , বুরবোঁ রাজবংশের সমর্থকগণ জুলাই রাজতন্ত্র ও লুই ফিলিপের ক্ষমতালাভকে অন্যায্য বলে ঘোষণা করেন , ফ্রান্সের সাধারণতন্ত্রী দল ( রিপাবলিকান ) মনে করেছিল লুই ফিলিপ উদারপন্থী নীতি গ্রহণ করে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাবেন , বোনাপার্টিস্ট দল নেপোলিয়নের গৌরবময় শাসনকালের সঙ্গে তুলনা করে লুই ফিলিপের শাসনকালকে ঘৃণ্য ও দুর্বল বলে দাবী করেন। এইভাবে রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক সংঘাত জুলাই রাজতন্ত্রের পতনকে অনিবার্য করে তোলে।
৭. সমাজতন্ত্রী দলের ( রিপাবলিকান ) বিরোধিতা :-
সমাজতন্ত্রী দলের নেতা লুই ব্ল্যাঙ্ক ( Louis Blanc ) সমাজতন্ত্রী আদর্শের সমর্থনে রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। তিনি লুই ফিলিপের রাজতন্ত্রকে ধনীদের দ্বারা গঠিত , ধনীদের জন্য ও ধনীদের দ্বারা পরিচালিত সরকার বলে কটাক্ষ করেন। তিনি লুই ফিলিপের সরকারকে প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী বলে প্রচার করেন। তাই লুই ব্ল্যাঙ্ক রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান করেন।
৮. শিল্পবিপ্লবের প্রভাব :-
শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। পুঁজিপতিদের হাতে অভূতপূর্ব অর্থের সমাগম হয়। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণী ছিল শোষিত ও বঞ্চিত। তাঁদের মজুরি ছিল কম এবং জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এই পরিস্থিতিতে লুই ব্ল্যাঙ্ক ও অপর সমাজতন্ত্রী নেতা সেন্ট সাইমন শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। তাঁরা প্রচার করেন শ্রমিকের অধিকার সুনিশ্চিত করার একমাত্র পথ হল রাজতন্ত্রের অবসান।
৯. অর্থনৈতিক নীতির ব্যর্থতা :-
জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল লুই ফিলিপের অর্থনৈতিক নীতির ব্যর্থতা। প্রকৃতপক্ষে , কোনো প্রগতিশীল অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে লুই ফিলিপ ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। অধিকারভোগী বুর্জোয়ারা যেসকল অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করতেন তা কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে ; ফ্রান্সের সাধারণ জনগণ তাতে উপকৃত হতেন না। এরপর ১৮৪০ থেকে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে তীব্র খরা দেখা দেয়। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও লুই ফিলিপ কোনো প্রগতিশীল আর্থিক নীতি প্রবর্তন করেননি।
১০. ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮) ও জুলাই রাজতন্ত্রের পতন :-
উপরোক্ত বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য ফ্রান্সে আরেকটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সংস্কারপন্থী ও প্রজাতন্ত্রীরা তীব্রভাবে সংস্কারের দাবী জানাতে থাকলে গিজো - মন্ত্রিসভা তাতে অসম্মতি জানায়। তাতে সংস্কারপন্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে এক বিরাট সমাবেশের আহ্বান জানায়। সরকার এই জনসভাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করলেও প্রচুর মানুষ তাতে যোগদান করেন। ফলে ভীত হয়ে লুই ফিলিপ গিজো - মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করেন। এই পরিস্থিতিতে সংস্কারপন্থীরা যখন গিজোর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন তখন পুলিশের গুলিতে ২৩ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। এই খবর ফ্রান্সে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র মানুষ অস্ত্র হাতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নিরুপায় লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডে পলায়ন করেন ও আশ্রয় গ্রহণ করেন।
এরপর সমাজতন্ত্রী ও সংস্কারপন্থীরা মিলিতভাবে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করে লা মার্টিনের নেতৃত্বে ১৮৪৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে সাধারণতন্ত্র ঘোষণা করেন। এইভাবে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন সম্পূর্ণ হয়।
0 comments