­
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব , প্রভাব ও ফলাফল। - NANDAN DUTTA

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব , প্রভাব ও ফলাফল।

by - April 20, 2025

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব , প্রভাব ও ফলাফল। 




ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব , প্রভাব ও ফলাফল :- 

১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপের ইতিহাসে ছিল একটি যুগান্তকারী এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। অর্লিয়েন্স বংশীয় রাজা লুই ফিলিপ গণআন্দোলনের চাপে ভীত হয়ে ইংল্যান্ডে পলায়ন করেন। সমাজতন্ত্রী (রিপাবলিকান ) ও প্রজাতন্ত্রীরা লা - মার্টিনের নেতৃত্বে ১৮৪৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে সাধারণতন্ত্র ঘোষণা করে। এই ঘটনা ফ্রান্সে '' দ্বিতীয় সাধারণতন্ত্র '' নামে পরিচিত। 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফলকে দুইভাবে আলোচনা করা যেতে পারে - 
(ক ) ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব এবং 
(খ ) ইউরোপে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব। 

(ক ) ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব :- 


১. সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি :- 
ইতিপূর্বে অষ্টাদশ লুইয়ের আমলে কেবলমাত্র ৩০০ ফ্রাঁ কর প্রদানকারী ব্যক্তিদের ভোট প্রদানের অধিকার ছিল। তারপর ১৮৩০ সালে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে লুই ফিলিপ ২০০ ফ্রাঁ কর প্রদানকারী ব্যক্তিদের ভোট প্রদানের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেন। তৎকালীন সময়ে সমগ্র ফ্রান্সে মাত্র তিন লক্ষ মানুষের ভোটাধিকার ছিল। কিন্তু ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। 

২. জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পুনর্বিন্যাস :-
ইতিপূর্বে ফ্রান্সের জাতীয় রক্ষীবাহিনী কেবলমাত্র বুর্জোয়াদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর গণতন্ত্রিতকরণ সম্পন্ন হয় তাতে যোগদানের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমানাধিকার স্বীকৃত হয়। 


৩. প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচনা :- 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সে প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়। এর ফলে ফ্রান্সের আইনসভার গঠন ও ক্ষমতা এবং শাসন ব্যবস্থা প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। আইনবিভাগের সকল সদস্য জনগণের ভোটে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন এবং রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের দ্বারাই নির্বাচিত হবেন - এমনটা স্থির করা হয়। 

৪. এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা স্থাপন :- 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় এবং ৭৫০ জন সদস্যের এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা স্থাপিত হয়। এই সকল সদস্যই সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত আইনসভার মেয়াদ স্থির করা হয় চার বছর। এছাড়া রাষ্ট্রপতির কার্যকালও চার বছরের জন্য স্থির করা হয়। 

৫. রাজতন্ত্রের অবসান :- 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে। ইতিপূর্বে ফরাসি বিপ্লবের সময়কালে বুরবোঁ রাজবংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তারপর ভিয়েনা সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে বুরবোঁ শাসনতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতন ঘটলেও অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে লুই ফিলিপের জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৬. জাতীয় কর্মশালা :- 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর প্রজাতান্ত্রিক সরকার দ্বারা ফ্রান্সে জাতীয় কর্মশালা বা ন্যাশনাল ওয়ার্কশপ গঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষদের কর্মসংস্থান ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা। গৃহীত নীতির ভিত্তিতে শ্রমিকরা ১০ ঘন্টার বেশি কাজ করবেন না বলে স্থির হয়। এছাড়াও সকলের জন্য কর্মের অধিকার স্বীকৃত হয়। 

৭. বুর্জোয়াদের ক্ষমতার অবসান :- 
ইতিপূর্বে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে জুলাই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও আইনবিভাগ ও শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতেই ন্যাস্ত ছিল। বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বুর্জোয়াদের সকল প্রকার রাজনৈতিক ও বিশেষ ক্ষমতার অবসান ঘটে এবং সকল ক্ষমতা সাধারণ মানুষের হাতে অর্পিত হয়।  

৮. ভূমিদাস প্রথার অবসান :- 
ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হয়। এর ফলে ফ্রান্সে এবং ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে এবং লক্ষাধিক মানুষ দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করেন।   


৯. পাতি - বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্ষমতা দখল :- 
প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্সে প্রজাতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত শুরু হয়। প্রজাতন্ত্রীরা ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রী লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখেরা কর্মের অধিকার সুনিশ্চিতকরণ , ধনবন্টন - ইত্যাদির মাধ্যমে ফ্রান্সে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ সমাজতন্ত্রীদের মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ করা হয়। তারপর সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদের সংগঠিত করে বিদ্রোহ শুরু করলে প্রজাতান্ত্রিক সেনাপতি ক্যাভিগন্যাক প্রায় দশ হাজার শ্রমিককে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ফরাসি প্রজাতন্ত্রে শ্রমিকদের অধিকার বিলুপ্ত হয় এবং পাতি বুর্জোয়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১০. মেটারনিখ ব্যবস্থার অবসান :- 
১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হল মেটারনিখ ব্যবস্থার অবসান। নেপোলিয়নের পতনের পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কাল অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ভিয়েনা সম্মেলনের নীতিগুলি সমগ্র ইউরোপ জুড়ে কার্যকর করা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটলে মেটারনিখ উপায়ান্তর না দেখে ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে মেটারনিখ তন্ত্রের অবসান ঘটে। 

(খ ) ইউরোপে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব। 


১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয়। যেহেতু তৎকালীন সময়ে ফ্রান্স ছিল সমগ্র ইউরোপের ঝটিকাকেন্দ্র , তাই ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনাই ইউরোপে তার প্রভাব বিস্তার করত। এপ্রসঙ্গে মেটারনিখ বলেছিলেন - When France catches cold, Europe sneezes. 
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব হিসাবে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ও ঘটনাপ্রবাহ দেখা যায়। যেমন - 

(i). অস্ট্রিয়া :- ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ও মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ার মিলান , ভেনিস , হাঙ্গেরি , ভিয়েনা - ইত্যাদি প্রদেশে গণ আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা পরিচালিত এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে অস্ট্রিয়ার সম্রাট বাধ্য হয়ে উদারনৈতিক শাসন ব্যবস্থার ঘোষণা করে পদত্যাগ করেন। এই ঘটনার পর লন্ডন টাইমস পত্রিকায় লেখা হয় - The last beam of the old system has given way.   

(ii). বোহেমিয়া :- বোহেমিয়া ছিল অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার দাবীতে চেক ও শ্লাভ জাতিগোষ্ঠী আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার সম্রাট স্বাধীন চেক রাষ্ট্রের ঘোষণা করেন। 

(iii). হাঙ্গেরি :- হাঙ্গেরিতে গণআন্দোলনের নেতা ছিলেন লুই কুসুথ। হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি নামে পরিচিত লুই কুসুথের প্রবল বেক্তিত্ব ও তীব্র গণআন্দোলনের চাপে অস্ট্রিয়ার সম্রাট সকল দাবী মেনে নিতে বাধ্য হন। 

(iv). জার্মানি :- জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের তীব্র প্রভাব পড়ে। তীব্র গণ আন্দোলন বেডেন , প্রাশিয়া , ব্রান্সউইক - ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্র্যাঙ্কফুট পার্লামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গঠনের লক্ষ্যে প্রাশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডারিক উইলিয়ামকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাটপদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যটি আরও একধাপ এগিয়ে যায়। উদারনীতিবাদ জার্মানির সর্বত্র জয়লাভ করে। 

(v) ইটালি :- ইটালিতে ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ভেনিস শহরেও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে পিডমন্ট - সার্ডিনিয়ায় ব্যাপক গণআন্দোলনের ফলে সেখানে উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তিত হয়।   

(vi) ডেনমার্ক :- প্রবল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিক সংবিধান সভা আহ্বান করেন। 

(vii) ইংল্যান্ড :- ইংল্যান্ডে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে চার্টিস্ট আন্দোলন তীব্রতর হয়। এছাড়াও ইংল্যান্ডে এক তীব্র সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয় ইয়ং আয়ারল্যান্ড দলের নেতৃত্বে। 

পরিশেষে বলা যায় , ১৮৪৮ সালের ইতিবাচক প্রভাবগুলি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ফ্রান্স সহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল , সমাজতন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রী ভাবাদর্শের সংঘাত , রাজতন্ত্রের পুনরুত্থান - ইত্যাদি কারণে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সুফলগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবুও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কেননা , ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল ভিয়েনা চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয় ; অন্যদিকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে জাতীয়তাবাদ প্রসারিত হয়।   

You May Also Like

0 comments