ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ :-
১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপে বিপুল প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন রাজতন্ত্রের পতন ঘটে অন্যদিকে ফরাসি প্রগতিশীল ভাবাদর্শগুলি নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের যে পরিবর্তনগুলি সংগঠিত হয় , সেগুলি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সকল সাফল্য ছিল সাময়িক। আসলে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় তার ভিত্তি ছিল দুর্বল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পতনের কারণগুলি ছিল -
১. দুর্বল প্রজাতন্ত্র :-
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে অর্লিয়েন্স রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র জন্ম নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত মজবুত ছিল না। কেননা , কেবলমাত্র প্যারিস ও ও তার পার্শ্ববর্তি অঞ্চলের নাগরিকেরই প্রজাতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সমগ্র ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলগুলিতে এর প্রভাব ছিল নগন্য। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ফ্রান্সের কৃষকেরা প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হননি। তাই গ্রামাঞ্চলের মানুষ ছিলেন দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে উদাসীন।
২. প্রজাতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের মতবিরোধ :-
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রজাতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। লা মার্টিন প্রমুখ প্রজাতান্ত্রিকরা ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ সমাজতান্ত্রিকরা শ্রমিকের অধিকার , ধন বন্টন , কর্মসংস্থান - ইত্যাদি প্রগতিশীল সংস্কারের দাবী জানালে উভয় মতাদর্শের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ তৈরী হয় এবং লুই ব্ল্যাঙ্ককে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর লুই ব্ল্যাঙ্কের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদের সংগঠিত করে বিদ্রোহ শুরু করলে প্রজাতান্ত্রিক সেনাপতি ক্যাভিগন্যাক প্রায় দশ হাজার শ্রমিককে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ফরাসি প্রজাতন্ত্রে শ্রমিকদের অধিকার বিলুপ্ত হয় এবং পাতি বুর্জোয়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. কর্মহীন শ্রমিকদের বিক্ষোভ :-
শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে জাতীয় শ্রম শিবির স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থানের পরিবর্তে শ্রমিকদের ২ ফ্রাঁ করে ভাতা দেওয়ার প্রকল্প চালু করা হয়। এতে শ্রমিকদের মধ্যে সন্তোষ দানা বাঁধে। সমাজতান্ত্রিকরা অভিযোগ করতে থাকে যে , শ্রমিকদের এইভাবে কর্মসংস্থানের পরিবর্তে ভাতা প্রদান করে সরকার শ্রমিকদের ভিক্ষুকে পরিণত করতে চায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিকদের সেই দাবী সম্পর্কে প্রজাতন্ত্রীরা ছিলেন উদাসীন। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ আরো তীব্র হয়।
৪. প্রজাতান্ত্রিক দলের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি :-
ফরাসি পার্লামেন্টের নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রীদল বিপুল ভোটে জয়লাভ করলে তারা সংস্কারমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিগুলিকে বাতিল করে এবং সমতন্ত্রীদের সকল গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ থেকে অপসারিত করে। এমনকি জাতীয় শ্রম শিবির বন্ধ করে দিলে শ্রমিকরা বিপ্লবের পথ বেছে নেয়।
৫. গৃহযুদ্ধ :-
উক্ত পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা প্যারিসের রাস্তা অবরোধ করে এবং প্রজাতন্ত্রী সেনাপতি ক্যাভিগন্যাক প্রায় দশ হাজার শ্রমিককে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন। এর ফলে প্রজাতন্ত্রী সরকার - কৃষক , শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সমর্থন হারায় ; প্রজাতন্ত্রের রক্তাক্ত হাত মানুষকে প্রজাতন্ত্র বিরোধী করে তোলে ; এছাড়া এই গৃহযুদ্ধের ফলে শিল্প , ব্যবসা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি - শৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৬. অর্থনৈতিক সংকট :-
গৃহযুদ্ধ , ব্যবসা - বাণিজ্যে মন্দা , কৃষি উৎপাদনে ব্যর্থতা - ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সামনে অর্থনৈতিক সংকট উপস্থিত হয়। অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এলে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে এবং প্রজাতান্ত্রিক সরকার শীঘ্রই জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে।
৭. কৃষকদের উপর কর আরোপ :-
অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে প্রজাতান্ত্রিক সরকার উপায়ান্তর না দেখে অর্থনৈতিক সংস্কার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে কৃষকদের উপর নতুন করে করের বোঝা চাপানো হয়। অন্যদিকে কৃষকেরা পূর্ব হতেই ছিল দরিদ্র ও অধিকার বঞ্চিত। তাই তাঁরা এই বাড়তি কর প্রদান করতে অসম্মত হন। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে।
৮. কর্মপন্থা সংক্রান্ত মতানৈক্য :-
এছাড়া প্রজাতান্ত্রিক সরকারের মধ্যেও কর্মপন্থা বিষয়ে মতানৈক্য প্রবল ছিল। ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কোন পন্থা অবলম্বন করা হবে - তা স্থির করতে তাঁরা অপরাগ ছিলেন। অনেকগুলি পরস্পরবিরোধী চিন্তাদর্শ সামনে আসে। একদল ফ্রান্সে সার্ডিনিয়া - পিডমন্টের রাজার অধীনে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ; অপর এক দল পোপের নেতৃত্বে ফ্রান্সে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আবার অন্যদিকে কেউ কেউ সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। এই পরস্পর বিরোধী মতাদর্শ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রকে আরো সংকটজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়।
৯. সামরিক শক্তির প্রভাব :-
সামরিক শক্তি উদারনৈতিক বিপ্লব গুলিকে দমন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজতন্ত্র বিরোধী কোনো বিদ্রোহেই সামরিক শক্তি যোগদান করেনি। অস্ট্রিয়ার সমগ্র সামরিক বাহিনী অস্ট্রিয়ার সম্রাটের প্রতি অনুগত ছিল। এছাড়াও প্রাশিয়ার সামরিক বাহিনীও রাজার প্রতি অনুগত ছিল। ফলে , ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়াশীল ও পরিবর্তনকামী বিদ্রোহগুলিকে দমন করতে সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হয়।
১০. রাষ্ট্রপতি পদে লুই নেপোলিয়নের নির্বাচন ও দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান :-
এরপর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বংশধর লুই নেপোলিয়ন বিপুল ভোটে প্রজাতন্ত্রী দলের প্রার্থী ক্যাভিগন্যাক-কে পরাজিত করেন। লুই নেপোলিয়ন প্রজাতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। ফলে তিনি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২ রা ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভেঙে দেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় তিনি খুব সহজেই দ্বিতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
একদিকে মানুষ প্রজাতান্ত্রিক শাসনের দুর্বলতা ও অকর্মণ্যতা লক্ষ্য করে প্রজাতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন , অন্যদিকে লুই নেপোলিয়ন ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বংশধর। ফলে ফ্রান্সের মানুষের নিকট তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। সাধারণ মানুষ প্রজাতন্ত্র অপেক্ষা স্থিতিশীল সরকার কামনা করেছিল। অন্যদিকে কৃষকরা মনে করেছিল , লুই নেপোলিয়ন তাঁদের অধিকার ও সম্পত্তি রক্ষা করবেন। এছাড়া নেপোলিয়ন বোনাপার্টের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় লুই নোপোলিয়ন ফিরিয়ে আনবেন - সাধারণ মানুষ এমনটা আশা করেছিলেন। এরপর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ২ রা ডিসেম্বর লুই নেপোলিয়ন দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করেন এবং এর সঙ্গে সঙ্গে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
0 comments