­
মেটারনিকের সাফল্যের কারণগুলি আলোচনা কর। - NANDAN DUTTA

মেটারনিকের সাফল্যের কারণগুলি আলোচনা কর।

by - April 22, 2025

মেটারনিকের সাফল্যের কারণগুলি আলোচনা কর।  




মেটারনিকের সাফল্যের কারণ :- 


ইউরোপের ইতিহাসে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা সম্মেলনের পর থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পর্যন্ত সময়কাল মেটানিকের যুগ নামে পরিচিত। মেটারনিখ তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব , রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা , কূটনৈতিক জ্ঞান - ইত্যাদির সাহায্যে প্রায় তিন দশক ধরে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পেছনে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য ও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং ফরাসি বিপ্লব প্রসূত উদারনৈতিক ভাবধারাকে প্রতিহত করা। যদিও ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে মেটারনিখ তন্ত্রেরও পতন ঘটে ; তবুও বলা যায় , ভিয়েনা কংগ্রেস থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পর্যন্ত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। মেটারনিকের সাফল্যের কারণগুলি হল - 

১. রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা :- 
মেটারনিখ ছিলেন প্রখর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসূত প্রগতিশীল ভাবধারা ইউরোপের স্থিতিতাবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক। তাই তিনি ছিলেন রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্রের প্রধান প্রতিনিধি। তাই মেটারনিখ খুব  সহজেই বিভিন্ন রাজপরিবার , রাজতন্ত্রের সমর্থকদের সমর্থন লাভ করেন। ফলে মেটারনিখ সফলভাবে তাঁর নীতিগুলি বাস্তবায়ন করতে পারেন। 

২. কূটনৈতিক ক্ষমতা :- 
মেটারনিখ উপলব্ধি করেছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমগ্র ইউরোপীয় রাজনীতিকে একসূত্রে বেঁধে ফেলতে হবে। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্স সহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি বিপ্লবের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মেটারনিখ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজতন্ত্রের সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। 


৩. বিগ ফোর - এর সদস্য হিসাবে বিশেষ মর্যাদা :- 
নেপোলিয়নের পতনের পর অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া , রাশিয়া ও ইংল্যান্ডকে নিয়ে গড়ে ওঠে বিগ ফোর। অস্ট্রিয়া ছিল এই বিগ ফোর এর প্রধান শক্তি। ফলে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইউরোপীয় রাজনীতিতে মেটারনিখ বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। ইউরোপীয় রাজনীতিতে তাঁর আদর্শ , নীতি ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হত। 

৪. রাজতন্ত্রের সমর্থনলাভ :- 
মেটারনিখ ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায্য অধিকার নীতির মাধ্যমে নেপোলিয়ন পূর্ববর্তী ইউরোপের সকল বৈধ রাজবংশগুলির সিংহাসন লাভের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ফলে ইউরোপীয় সকল রাজশক্তি মেটারনিখকে রাজতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসাবে মনে করে। এইভাবে ইউরোপীয় প্রায় সকল রাজবংশগুলির সমর্থন লাভ করে মেটারনিখ ইউরোপীয় রাজনীতিতে অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলেন। 

৫. স্থিতাবস্থার প্রতি সমর্থন :- 
ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রগতিশীল ভাবধারার বিকাশ ঘটলেও বহু ঘটনা এমনও ছিল যেগুলি বিপ্লবের প্রতি এক শ্রেণীর মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। ফরাসি বিপ্লবের পর ডাইরেক্টরি ও কনসুলেটের শাসন এবং তারপর নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদ - কোনোকিছুই মানুষের আশা - আকাঙ্খাকে চরিতার্থ করতে পারেনি। তাঁরা মেটারনিকের স্থিতাবস্থা রক্ষার নীতিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। 

৬. যাজকতন্ত্রের সমর্থনলাভ :- 
ফরাসি বিপ্লবের পর যাজকদের ক্ষমতা বহুলাংশে কমে যায় , চার্চের সম্পত্তি যাজকদের হস্তচ্যুত হয়। এরপর নেপোলিয়নের সময়কালে যাজকদের ক্ষমতা আরও সংকুচিত হয়। ফলে ভিয়েনা সম্মেলনের পর পুরাতনপন্থী মেটারনিকের পক্ষে যাজকদের সমর্থন পেতে সমস্যা হয়নি। 

৭. নেপোলিয়নের পতনে মেটারনিকের ভূমিকা :- 
নেপোলিয়নের পতনে মেটারনিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে নেপোলিয়নের পতনের পর মেটারনিকের রাজনৈতিক দক্ষতা ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রশংসিত হয়। এছাড়া নেপোলিয়নের পতনের ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের যে শূন্যতা তৈরী হয় , মেটারনিখ সহজেই তা পূরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 


৮. প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী :- 
মেটারনিখ ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এছাড়াও তিনি ছিলেন  সুবক্তা। ফলে নিজের নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের সমর্থনলাভের ক্ষেত্রে তাঁর এই গুণটি ছিল বিশেষভাবে কার্যকরী। তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা , জ্ঞান , বিশ্লেষণ ক্ষমতা - ইত্যাদি ব্যক্তিগত গুণগুলি মেটারনিককে নেতৃত্বের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল। 

৯. বৈবাহিক সম্পর্ক :- 
মেটারনিখ অস্ট্রিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট কৌণিক এর পৌত্রীর সঙ্গে বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ফলে খুব সহজেই অস্ট্রিয়ার রাজনীতিতে প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন।      

১০. শক্তি সাম্য নীতির সফল প্রয়োগ :- 
মেটারনিকের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শক্তি ক্ষেত্রে সমতা আনা। এই উদ্দেশ্যে তিনি ভিয়েনা সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে সমগ্র ইউরোপের পুনর্বিন্যাস করেন। ফলে ইউরোপে শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে বৈপ্লবিক ভাবাদর্শগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১১. ভিয়েনা সম্মেলনের নিয়ন্ত্রক হিসাবে ভূমিকা :- 
নেপোলিয়নের পতনের পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে ভিয়েনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন বিজয়ী রাষ্ট্র এবং পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ। ফলে স্বভাবতই ইউরোপীয় রাজনীতিতে ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রাজনীতিকে পরিচালনার অধিকার মেটারনিকের হাতে চলে আসে। 

১২. বৈপ্লবিক ভাবাদর্শ প্রতিরোধ :- 
মেটারনিখ সফলভাবে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক ভাবধারাগুলির প্রতিরোধ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সমগ্র ইউরোপকে তিনি এক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। করেন ফ্রান্স সহ সমগ্র ইউরোপে বিপ্লব প্রতিহত হয় এবং মেটারনিকের অধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , মেটারনিখ দৃঢ় ভিত্তিতে রক্ষনশীলতা ও পুরাতনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও বিপ্লব ও বৈপ্লবিক ভাবাদর্শগুলিকে উপেক্ষা করে তিনি চরম ভুল করেছিলেন। ফলে অচিরেই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মেটারনিখ ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে।     

You May Also Like

0 comments