সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী কাকে বলে ? সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।

by - March 27, 2024

সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী কাকে বলে ? সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।  




সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ধারণা / সংজ্ঞা। 


আধুনিককালে শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পাঠক্রমের মধ্যে আবদ্ধ রেখে তাদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটান সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীর মানসিক , বৌদ্ধিক , প্রাক্ষোভিক , নৈতিক , বৃত্তিমূলক , সাংস্কৃতিক - ইত্যাদি বিভিন্ন বিকাশের কথা মাথায় রেখে পাঠক্রমের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক কার্যাবলী পরিচালনা করা হয়। তাই বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় বহিৰ্ভূত সকল প্রকার কার্যাবলিই সহপাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত।    

মনোবিদ Park বলেছেন - শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বৈচিত্রময় পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটানোই হল সহপাঠক্রম। 

Jamieson বলেছেন - সহপাঠক্রম পাঠক্রমের উদ্দেশ্যগুলিকে বাস্তবায়িত করে। 

Pica Smith বলেছেন - সহপাঠক্রম শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমের বোঝাকে সহজতর করে তোলে। 

Poynton বলেছেন - সহপাঠক্রম হল শিক্ষার সেই অংশ যা শিশুদের বৃত্তিমূলক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক - ইত্যাদি বিভিন্ন দিকের সঙ্গে তার পরিচিতি ঘটায় ও পরবর্তী জীবনে সেগুলিতে অংশগ্রহণের পথকে মসৃন করে তোলে। 

Kohen বলেছেন - যা বিদ্যালয়ের ভিতরে ও বিদ্যালয়ের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুদের পারদর্শিতার পথ উন্মুক্ত করে। 

সুতরাং সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী হল - বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বিদ্যালয়ের বাইরে সেই সকল পরিকল্পিত কার্যাবলী যা শিক্ষার্থীদের জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তরে পরিচালিত হয় ; শিশুদের মধ্যে সর্বাঙ্গীন বিকাশকে তরান্বিত করে ; পাঠক্রমের উদ্দেশ্যগুলিকে পূরণ করে ; শিক্ষাকে বৈচিত্রমুলক করে তোলে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়ক হয়ে ওঠে।      


সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বৈশিষ্ট :- 


সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি হল - 

১. বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে পরিচালিত :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে - উভয় ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয়। বিদ্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , বিদ্যালয়ের জন্মদিবস পালন , স্বাধীনতা দিবস পালন - ইত্যাদি এবং বিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষামূলক ভ্রমণ , বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির , সমাজেবা - ইত্যাদি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করে শিশু বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। 

২. পাঠক্রমের সহায়ক :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি সর্বদা পাঠক্রমের সহায়ক। পাঠক্রমের মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ। কিন্তু শুধুমাত্র পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সহপাঠক্রম সেই ঘাটতি পূরণ করে পাঠক্রমের সহায়ক হয়ে ওঠে। 

৩. বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতার সঞ্চালন :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি প্রকৃতিগতভাবে বৈচিত্রপূর্ণ। তাই সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। এই বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা শিশুর জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তরে তাদেরকে দক্ষ ও উপযুক্ত করে তোলে। 

৪. সৃজনশীলতার বিকাশ :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশে সহায়ক। শিক্ষার্থীরা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাগুলি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ছবি আঁকা , বিভিন্ন খেলা , হাতের কাজ , সাহিত্য চর্চা - বিদ্যালয়ে পালিত এই সকল বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে উন্মুক্ত করে তোলে। 

৫. শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়ক :- 
শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য প্রয়োজন দৈহিক , মানসিক , বৌদ্ধিক , সাংস্কৃতিক , সামাজিক , নৈতিক , বৃত্তিমূলক - ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের চাহিদা পূরণ। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার্থীর এই ভিন্ন ভিন্ন চাহিদাগুলিকে পূরণ করে ও সেইসকল নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বিকাশ ঘটায়। এই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণ হওয়ার জন্য তার সর্বাঙ্গীন বিকাশ সংগঠিত হয়। 

৬. সামাজিকীকরণে সহায়ক :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণে সহায়ক। বেশিরভাগ সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি পালিত হয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে। ফলে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থী সমাজ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ও সমাজে নিজের ভূমিকাকে চিহ্নিত করতে পারে। এর ফলে সমাজ ও শিক্ষার্থীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া গড়ে ওঠে। 


৭. আগ্রহের উদ্দীপক :- 
বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পাঠক্রম এবং তার সঙ্গে সঙ্গে পঠন - পাঠন কখনো - কখনো শিক্ষার্থীর কাছে একঘেঁয়ে হয়ে ওঠে। এইসময় বিদ্যালয়ে পরিচালিত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার্থীদের বৈচিত্রময় পরিস্থিতি উপহার দেয়। ফলে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে এবং এর ফলে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক উদ্দেশ্যগুলি পূরণ হয়। 

৮. জাতীয়তাবোধের বিকাশ :- 
বিদ্যালয়ে পালিত বিভিন্ন জাতীয় দিবস - যেমন - স্বাধীনতা দিবস পালন , প্রজাতন্ত্র দিবস পালন ; বিভিন্ন মনীষীর জন্মদিবস পালন - যেমন - স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবস পালন , নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবস পালন ; বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যাবলি - ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার জাতীয় জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে। 

৯. আন্তর্জাতিকতাবোধের বিকাশ :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবোধের বিকাশে সহায়ক। বিদ্যালয়ে পালিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়। যেমন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালন , বিশ্ব নারী দিবস পালন - ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক কর্মকান্ড ও কর্মসূচিগুলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ফলে তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবোধ গড়ে ওঠে। 

১০. গণতান্ত্রিকতার বিকাশে সহায়ক :- 
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর একমাত্র পরিচয় হল যে একজন ছাত্র বা ছাত্রী। বিদ্যালয়ে বংশপরিচয় , সামাজিক শ্রেণী , বর্ণ , অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একই সঙ্গে বসে , একই সঙ্গে খেলাধূলা করে , একই সঙ্গে টিফিন খায় ; সর্বপরি , বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে তারা দলগতভাবে অংশগ্রহণ করে। এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটে এবং তারা গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়। 

১১. বিভিন্নতা :- 
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি সর্বদা ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন বিদ্যালয়ে পালিত প্রধান চারটি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি হল - বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবস পালন , বাগান তৈরী ও পরিচর্যা , শ্ৰেণীকক্ষ পরিচ্ছন্নতা , জাতীয় দিবস পালন। এই চারটি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী চরিত্রগতভাবে পরস্পর ভিন্ন। 

১২. মূল্যায়নের অনুপস্থিতি :- 
বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি পরিচালিত হয়। কিন্তু এগুলির সঙ্গে পরীক্ষা বা মূল্যায়নের কোনো সম্পর্ক থাকেনা। শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থিত বিভিন্ন সমস্যামূলক পরিস্থিতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সহপাঠক্রমের মূল্যায়ন সংগঠিত হয় ; কিন্তু প্রথাগত কোনো মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়না।     


You May Also Like

0 comments