পাঠক্রমের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।
পাঠক্রমের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।
পাঠক্রম কাকে বলে ? পাঠক্রমের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
পাঠক্রমের ধারণা / সংজ্ঞা :-
বাংলা পাঠক্রম শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Curriculum এবং এই শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে ; যার অর্থ হল দৌড়। আবার Curriculum শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য দৌড়ের পথ। কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিজ্ঞানীদের মতে পাঠক্রম :-
পেইনি (Payne) বলেছেন - শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক সর্বাধিক বিকাশের জন্য বিদ্যালয়ে যা কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় , তাই হল পাঠক্রম।
কানিংহাম ( Cunninghum ) বলেছেন - নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়ের পরিবেশে শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার যন্ত্র হল পাঠক্রম।
পার্সি নান ( Percy Nunn ) বলেছেন - বিদ্যালয় জীবনে শিক্ষাগত আদর্শের প্রতিফলন ঘটে পাঠক্রমের মাধ্যমে।
জন ডিউই ( John Dewey ) বলেছেন - বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যা কিছু শেখার তার সুসংবদ্ধ রূপ হল পাঠক্রম।
ফ্রয়েবেল বলেছেন - পাঠক্রম হল মানব সভ্যতার সামগ্রিক জ্ঞানের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।
মুদালিয়র কমিশন পাঠক্রম সম্পর্কে তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন - পাঠক্রম শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিক্ষা নয় ; তার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ , বিদ্যালয়ের বাইরের পরিবেশ ও সমাজ ইত্যাদি সকল উপাদানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা হল পাঠক্রম।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলিকে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে - পাঠক্রম হল -
(ক ) বিদ্যালয়ে শিক্ষণীয় বিষয় ,
(খ ) একাধিক বিষয়ের সমষ্টি ,
(গ ) কতকগুলি উপাদান ও উপকরণের সমষ্টি ,
(ঘ ) বিদ্যালয় কর্তৃক পরিকল্পিত ,
(ঙ ) বিদ্যালয় ও শিক্ষক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ,
(চ ) সহপাঠক্রমিক বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্তি ,
(ছ ) শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা ,
(জ ) নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি।
পাঠক্রমের বৈশিষ্ট :-
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক :-
পাঠক্রম রচনার পূর্বে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হয়। পাঠক্রম হল শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছনোর একটি মাধ্যম। তাই শিক্ষার লক্ষ্যগুলিকে পূরণ করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পাঠক্রম রচনা করা হয়। ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশ , মানবিকতা ও নৈতিকতার বিকাশ , কর্মকেন্দ্রিক ও জীবিকা অর্জনে সহায়তা , বিভিন্ন বাস্তব সমস্যা সমাধানের কৌশল অর্জন , অভিযোজনে সহায়তা - ইত্যাদি বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে পাঠক্রম রচিত হয়।
২. পূর্বনির্ধারিত :-
পাঠক্রম সর্বদা পূর্বনির্ধারিত। যেকোনো শ্রেণীর পঠন পাঠন শুরু হওয়ার পূর্বেই পাঠক্রম স্থির করা হয়ে থাকে। সেই পাঠক্রম অনুযায়ী ওই নির্দিষ্ট শ্রেণীর পঠন - পাঠন পরিচালিত হয়। এছাড়া শিক্ষা নির্দেশনার ক্ষেত্রেও পূর্বনির্ধারিত পাঠক্রমকে অনুসরণ করা হয়।
৩. পরিবর্তনশীল :-
শিক্ষা একটি সামাজিক বিষয়। সমাজ যেহেতু পরিবর্তনশীল , তাই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও পরিবর্তনশীল। তাই পরিবর্তনশীল শিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠক্রমও পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবর্তন , প্রযুক্তির উন্নতি , জীবিকার ক্ষেত্রে পরিবর্তন , আদর্শগত পরিবর্তন - ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রমও সর্বদা পরিবর্তনশীল।
৪. শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল :-
পাঠক্রম রচনার সময় শিক্ষার্থীর বয়স ও সেই অনুপাতে তার সামর্থ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীর সামর্থ্যভিত্তিক পাঠক্রম রচিত না হলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ব্যার্থ হয়ে যাবে। তাই বিভিন্ন ধরণের সামর্থ্যের অধিকারী শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ সূত্র নির্ধারণ করে তাদের সামর্থ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রম রচনা করা হয়।
৫. অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা নির্মিত :-
পাঠক্রম রচনার দায়িত্বে থাকেন একদল অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। শিক্ষাবিজ্ঞানী , মনোবিজ্ঞানী , পরিবেশবিদ , প্রশাসক , অভিজ্ঞ শিক্ষক , সমাজবিজ্ঞানী , দার্শনিক - প্রমুখ বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সামগ্রিকভাবে পাঠক্রম রচনার পাঠক্রম রচনার দায়িত্ব পালন করেন।
৬. মূল্যায়নসাপেক্ষ :-
পাঠক্রম সর্বদা মূল্যায়নসাপেক্ষ। পাঠক্রমের মূল্যায়ন দুই প্রকারের ; যথা - প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়ন ও চূড়ান্ত মূল্যায়ন। মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জানার ও বোধগম্যতার স্তর যাঁচাই করা সম্ভব হয়। এছাড়াও পাঠক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতখানি কার্যকর হল - তা জানার জন্য মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. আদর্শগত ভিত্তি :-
প্রতিটি পাঠক্রম একটি নির্দিষ্ট আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই আদর্শ সমাজ , দর্শন , নৈতিকতা , মূল্যবোধ - ইত্যাদির নিরিখে প্রযুক্ত হয়। যেমন আধুনিক পাঠক্রম গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।
৮. বাস্তবসম্মত ভিত্তি :-
পাঠক্রম কখনোই বাস্তবতার দিকটিকে উপেক্ষা করেনা। বাস্তব জীবনে একজন শিক্ষার্থীকে যে ধরণের জ্ঞান ও কৌশল অর্জন করা প্রয়োজন , যে ধরণের বৃত্তিগত দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন - পাঠক্রম সেইসকল দিকের প্রতি সার্বিকভাবে গুরুত্ব প্রদান করে।
৯. শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশ :-
পাঠক্রম শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীর জ্ঞানমূলক চাহিদা , প্রাক্ষোভিক চাহিদা , নৈতিকতার চাহিদা , সামাজিকতার চাহিদা , জীবিকা অর্জনের চাহিদা - ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের চাহিদা পূরণ হয় পাঠক্রমের মাধ্যমে ; যার ফলে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব হয়।
১০. তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভিত্তির মেলবন্ধন :-
পাঠক্রমের মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকের মেলবন্ধন ঘটানো হয়। তাত্ত্বিক দিকের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ের তত্ত্বগত ধারণা উপলব্ধি করে এবং ব্যবহারিক দিকের মাধ্যমে সেগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার কৌশল আয়ত্ত্ব করে।
১১. মনোবৈজ্ঞানিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত :-
একটি পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে। পাঠক্রম রচনার পূর্বে শিক্ষার্থীর বয়স , মেধা , যোগ্যতা , সামর্থ্য , চাহিদা - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নির্ধারণ করতে মনোবিজ্ঞান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১২. কর্ম অভিজ্ঞতার গুরুত্ব :-
প্রতিটি আধুনিক পাঠক্রমে কর্ম অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্ম অভিজ্ঞতা হল - শিক্ষার্থী নিজের কাজ , পঠন - পাঠনে অংশগ্রহণ - ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেই অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এর ফলে শিক্ষার্থী সচেতনভাবে , কারো সাহায্য ছাড়াই ভবিষ্যৎ জীবনের বিভিন্ন জ্ঞান ও কৌশলগুলিকে আয়ত্ত্ব করতে পারবে।
0 comments