পাঠক্রম রচনার মূলনীতিগুলি আলোচনা কর।

by - March 19, 2024

পাঠক্রম রচনার মূলনীতিগুলি আলোচনা কর। 




পাঠক্রম রচনার মূলনীতি :- 


শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলিকে সার্বিক ও সদর্থক রূপ দিতে গেলে কিছু নীতির উপর ভিত্তি করে পাঠক্রম রচনা করতে হয়। পাঠক্রম রচনার এই নীতিগুলির সাহায্যে পাঠক্রমকে শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ বিকাশের উপাদান হিসাবে পরিণত করা হয়। পাঠক্রম নির্ধারণের মূলনীতিগুলি হল - 

১. শিক্ষার ব্যাপকার্থের নীতি :- 
আধুনিক শিক্ষায় পাঠক্রম শুধুমাত্র কয়েকটি কৌশল বা জ্ঞানের সমষ্টি নয় ; তা হল শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ  বিকাশের লক্ষ্যে নিযুক্ত হওয়া একটি উপাদান। তাই পাঠক্রমে শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থকে বর্জন করে শিক্ষার ব্যাপক অর্থকে গ্রহণ করা হয়। যথার্থ শিক্ষা নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পাঠক্রমকে শিক্ষার ব্যাপক ধারণা গ্রহণের উপযোগী করে তোলা হয়। 

২. শিক্ষাশ্রয়ী দর্শনের নীতি :- 
পাঠক্রমকে সর্বদা শিক্ষাশ্রয়ী দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। শিক্ষা সর্বদা দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। শিক্ষাশ্রয়ী দর্শন পাঠক্রমকে ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়। তাই পাঠক্রম নির্ধারণের সময় শিক্ষাশ্রয়ী দর্শনের নীতিগুলিকে অনুসরণ করা হয়। 

৩. সমাজতান্ত্রিকতার নীতি :- 
ব্যক্তির যাবতীয় দক্ষতা ও সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটে সমাজের মধ্যেই। তাই পাঠক্রম নির্ধারণের সময় ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। পাঠক্রম রচনার সময় ব্যক্তির প্রতি সমাজের কর্তব্য এবং সমাজের প্রতি ব্যক্তির দায়বদ্ধতা - ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। 


৪. কর্মকেন্দ্রিকতার নীতি :- 
কর্মকেন্দ্রিকতার নীতির মূলকথা হল - Learning by doing ; অর্থাৎ কাজের মাধ্যমে শেখা। পঠন পাঠনের সময় শুধুমাত্র বস্তু ও বিষয়কেন্দ্রিক জ্ঞান প্রদান শিক্ষার্থীকে পঠন পাঠনের প্রতি উৎসাহিত করেনা। তাই পাঠক্রম প্রণয়নের সময় কাজের মাধ্যমে স্বয়ং শিখনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

৫. কৃষ্টিমূলক ও সাংস্কৃতিক নীতি :- 
শিক্ষার একটি প্রধান কাজ হল সামাজিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ ও সঞ্চালন করা। তাই পাঠক্রম প্রণয়নের সময় সামাজিক ও ঐতিহ্যকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথার্থ সাংস্কৃতিক সঞ্চালন না ঘটলে সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবনমন ঘটবে। 

৬. ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতার নীতি :- 
প্রতিটি শিক্ষার্থী আগ্রহ , চাহিদা , সামর্থ্য , দক্ষতা - ইত্যাদির ভিত্তিতে পরস্পর পরস্পরের চেয়ে আলাদা। তাই পাঠক্রম প্রণয়নকালে বিভিন্ন চাহিদা ও সামর্থ্য যুক্ত শিক্ষার্থীদের সাধারণ ও বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যত্নশীল হতে হয়। পাঠক্রমের মাধ্যমে যাতে সকলে উপকৃত হতে পারে সেবিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।       

৭. গণতান্ত্রিকতার নীতি :- 
আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রকে সর্বোচ্চ মানবিক আদর্শ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক নীতি শিক্ষার্থীর মধ্যে যথার্থ সামাজিকীকরণ গড়ে তোলে। তাই পাঠক্রম নির্ধারণের সময় গণতান্ত্রিক আদর্শ যাতে পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চালিত হয় - সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। 

৮. শিশুকেন্দ্রিকতার নীতি :- 
আধুনিক কালে শিশুকে কেন্দ্র করেই শিক্ষা তথা পাঠক্রম পরিচালিত হয়। শিশুর বিভিন্ন চাহিদা , আগ্রহ , সামর্থ্য - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে গুরুত্ব প্রদান করে পাঠক্রম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই পাঠক্রমের মধ্যে শিশুকেন্দ্রিকতার নীতি প্রতিফলিত হয়। 

৯. অখন্ডতা ও অবিভাজ্যতা :- 
আধুনিক পাঠক্রমে অখন্ডতা ও অবিভাজ্যতার নীতি অনুসরণ করা হয়। পাঠক্রমকে খন্ড খন্ড করে বিভক্ত করা হলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। তাই পাঠক্রম রচনার সময় অখন্ডতা ও অবিভাজ্যতার নীতি অনুসরণ করে শিশুর স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। 


১০. সক্রিয়তার নীতি :- 
প্রতিটি পাঠক্রম রচনার সময় শিশুর সক্রিয়তার নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু সক্রিয় হয়ে পঠন - পাঠনে অংশগ্রহণ করলে শিশুর স্বাভাবিক আগ্রহ ও জ্ঞানার্জনের চাহিদা বিকশিত হবে। তাই সক্রিয়তার নীতির মাধ্যমে শিশুকে পাঠমুখী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। 

১১. পরিবর্তনশীলতার নীতি :- 
শিক্ষা একটি সামাজিক বিষয়। তাই সমাজ যেহেতু পরিবর্তনশীল ; তাই পাঠক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রেও পরিবর্তনশীলতার নীতি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন , প্রযুক্তি ও আদর্শগত পরিবর্তন - ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রমে পরিবর্তনশীলতার নীতি অনুসরণ করা হয়। 

১২. সমন্বয়ের নীতি :- 
পাঠক্রম রচনার সময় শিশুর চাহিদা , সামাজিক বিভিন্ন প্রত্যাশা , নৈতিকতা - মানবিকতা - সৃজনশীলতা - বৃত্তি - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা হয়। এইভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয়সাধনের ফলে পাঠক্রম শিক্ষার্থীর নিকট অনেক বেশি উপযোগী হয়ে ওঠে। 

১৩. সংরক্ষণের নীতি :- 
পাঠক্রম প্রণয়নের সময় সংরক্ষণের নীতি বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়। মানব সভ্যতা আজ পর্যন্ত যা যা জ্ঞান অর্জন করেছে - তার সংরক্ষণ অত্যন্ত আবশ্যিক। বিভিন্ন পূর্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানগুলিকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 

১৪. বৃত্তিমূলক নীতি :- 
শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য হল জীবিকা অর্জনে সহায়তা। তাই জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়গুলি , বর্তমান অর্থনীতি , কর্মসংস্থান - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে পাঠক্রমে স্থান দিয়ে শিক্ষার্থীকে  ভবিষ্যৎ জীবনে বৃত্তিগত ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের উপযুক্ত করে তোলা হয়। 

১৫. উৎপাদনশীলতার নীতি :- 
প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে উৎপাদনশীলতা গড়ে তোলা পাঠক্রমের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। পাঠক্রমের মধ্যে বাস্তব সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা প্ৰদান করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা গঠনের চেষ্টা করা হয়। 

১৬. ক্রমবিন্যাসের নীতি :- 
পাঠক্রম রচনার সময় ক্রমবিন্যাসের নীতি গুরুত্ব সহকারে অনুসরণ করা হয়। শিক্ষার্থীর মানসিক বয়স , জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা , অভিজ্ঞতা - ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন বয়সে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার স্তর তৈরী হয়। সেই দক্ষতার স্তরের সঙ্গে সঙ্গতিবিধান করতে পাঠক্রম রচনার সময় ক্রমবিন্যাসের নীতি অনুসরণ করা অত্যন্ত আবশ্যিক। 

You May Also Like

0 comments