শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য কাকে বলে ? শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।

by - October 06, 2023

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য কাকে বলে ? শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর। 



শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য :- 


শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের ধারণা :- 


শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন উন্নতির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের প্রবক্তাদের মতে ব্যক্তি হল প্রধান বিবেচ্য বিষয় এবং ব্যক্তির উন্নয়নের মাধ্যমেই সমাজের ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব। ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা একজন ব্যক্তির সবধরণের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাকে উপযুক্ত করে তোলে এবং উপযুক্ত ও সক্ষম ব্যক্তিবর্গের দ্বারাই সমাজের যাবতীয় কল্যাণ ও অগ্রগতি সাধিত হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্যতম প্রবক্তা রুশো ব্যক্তির বিকাশের উপরেই অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ ব্যক্তির মধ্যে থাকা অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনকেই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। 

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের প্রবক্তাগণ :- 


শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের প্রধান প্রবক্তাগণ হলেন - স্বামী বিবেকানন্দ , রুশো , টমাস শিল্ড , স্যার পার্সি নান , বার্ট্রান্ড রাসেল , সক্রেটিস - প্রমুখ। 


শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা :- 


(i) পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তি পরস্পরের তুলনায় স্বতন্ত্র্য। তাদের আশা - আকাঙ্খা , চাহিদা , মেধা , দক্ষতা - সবই স্বতন্ত্র্য। একমাত্র ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির সেই সকল ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কেবলমাত্র ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব। 

(ii) ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা প্রতিটি ব্যক্তিকে দক্ষ ও উৎপাদনশীল করে তোলে। এই দক্ষ ব্যক্তিবর্গ সমাজের কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত হয়। ব্যক্তির বহুমুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে সমাজের পক্ষে উপযোগী ও কার্যকর করে তোলে ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা। 

(iii) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের প্রধান ত্রুটি হল দলগত পঠন - পাঠন। দলগত পঠন - পাঠনে কখনোই ব্যক্তির স্বতন্ত্র্য সত্তার বিকাশ ঘটতে পারেনা। কিন্তু ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির একক সত্তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। 

(iv) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা কখনোই ব্যক্তিকে আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করে না। ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিকগণ আত্মোপলব্ধিকেই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। তাই একমাত্র ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি সম্ভব। 

(v) ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজেরও বিকাশ ও কল্যাণ সাধন করে। একটি সমাজে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গের দ্বারা সমাজ কল্যাণ সম্ভব হয়। তাই ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধিত হলে তার ফলস্বরূপ সমাজেরও কল্যাণ সাধিত হয়। 

(vi) জৈবিক মতবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন প্রতিটি মানুষ একটি পৃথক জৈবিক সত্তা। ব্যক্তির প্রয়োজনেই সমাজ গঠিত হয় , সমাজের প্রয়োজনে ব্যক্তি জন্ম নেয়না। তাই পরিবেশের মুখ্য উপাদান ব্যক্তি ; সমাজ নয়। যেহেতু ব্যক্তিই পরিবেশের মুখ্য উপাদান , সেহেতু ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব। 

(vii) আজ পর্যন্ত সমাজের যা কিছু কল্যাণ সাধিত হয়েছে , যা কিছু বিবর্তন হয়েছে - তা সমাজের কিছু নির্দিষ্ট দক্ষ ও প্রগতিশীল ব্যক্তির মাধ্যমে। তাই বলা যেতে পারে ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে দক্ষ করে তোলার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ উভইয়েরই কল্যাণ সাধন করে। 


শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের অসুবিধা :- 


(i) চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে আত্মসর্বস্ব ও স্বার্থপর করে তুলতে পারে। বস্তুতঃ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠনে সমাজের ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। তাই আত্মসর্বস্ব ব্যক্তি সমাজের পক্ষে কখনোই কল্যাণকর হতে পারেনা। 

(ii) ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর হয়ে ওঠে। এমনকী , সেই চূড়ান্ত ও অবাধ স্বাধীনতা সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারার ফলে ব্যক্তি নিজের জীবনকেও দুর্বিসহ করে তোলে। অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ব্যক্তিকে উশৃঙ্খল করে তোলে। 

(iii) শিক্ষার ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে বিশ্বাসী শিক্ষাবিদগণ প্রয়োগবাদের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। মনীষীদের দ্বারা সমাজকল্যাণ সাধিত হয় ঠিকই ; কিন্তু মনীষীগণ সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকেন - একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। 

(iv) প্রতিটি ব্যক্তি যেহেতু সমাজের অংশ তাই সমাজকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তির শিক্ষা , বেক্তিত্ব সবই সমাজের মধ্যেই নির্মিত হয়। তাই শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ কারো পক্ষেই মঙ্গলজনক নয়। 

(v) শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে কখনোই সমাজ কল্যাণকে উপেক্ষা করা যায়না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রবক্তাগণ ব্যক্তিকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করে সমাজকে উপেক্ষা করেছেন। এর ফলে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই প্রগতি ব্যাহত হয়। 

(vi) অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা কাম্য নয়। কেননা , সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার আর্থিক ভার বর্তমান কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই বহন করা সম্ভব নয়। 

পরিশেষে বলা যায় , শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের কিছু সুবিধা থাকলেও সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা কখনোই কাম্য নয়। শিক্ষা একটি সামাজিক বিষয়। তাই সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রবর্তিত হলে যে সমস্যাগুলি দেখা দেবে - তাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায়না।    

 

You May Also Like

0 comments