শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্য

by - October 04, 2023

শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্যগুলি আলোচনা কর।   

অথবা , শিক্ষার বিভিন্ন প্রকার লক্ষ্যগুলি কী কী ? 




শিক্ষার বিভিন্ন প্রকার লক্ষ্য :- 


যেহেতু শিক্ষা একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া - তাই শিক্ষার লক্ষ্যও বহুমুখী। শিক্ষা কখনোই লক্ষ্যহীন হতে পারেনা। সমাজ বিকাশ ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাই শিক্ষার লক্ষ্যগুলিও পরিবর্তনশীল। ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা দার্শনিকগণ শিক্ষার ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য সম্পর্কে আলোকপাত করলেও তাঁরা সকলেই শিশুর সার্বিক উন্নয়ন ও মানব জীবনের সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষার সাধারণ লক্ষ্যগুলি নিম্নরূপ। 

১. ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য :- 
ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য রচিত হয়। প্রতিটি ব্যক্তির দৈহিক , বৌদ্ধিক , সামাজিক , কৃষ্টিমূলক , নৈতিক , সৃজনশীল , প্রাক্ষোভিক , মূল্যবোধ - ইত্যাদি উপাদানের সর্বাঙ্গীন বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য পরিচালিত হয়। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যগুলির সমাবেশ ঘটিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ কল্যাণ উভয়ই চরিতার্থ করা সম্ভব হয়। 

২. সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য :- 
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যেই সে বেড়ে ওঠে এবং তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তাই ব্যক্তির সামাজিক দিকগুলির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে তার মধ্যে সামাজিকতার বিকাশ ঘটানোই হল শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য। যেহেতু ব্যক্তি , শিক্ষা ও সমাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত - তাই সামাজিক লক্ষ্যগুলি সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল। 

৩. জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য :- 
শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য হল জ্ঞানার্জন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার পরিচিত ও অপরিচিত জগৎ , কর্মজগৎ - ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তি বিশ্ব - ব্রহ্মান্ডের বিভিন্ন রহস্যের সঙ্গে পরিচিত হয় , আর্থ - সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত হয় , রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। 


৪. বৃত্তিমূলক লক্ষ্য :- 
শিক্ষা মানুষের মধ্যে উৎপাদনশীলতা তৈরি করে এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে পরিচিত হয়। বৃত্তিশিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার ভবিষ্যৎ কর্মকান্ডের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে। এককথায় বলা যায় , শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ব্যক্তিকে জীবিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। 

৫. শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের লক্ষ্য :- 
শিশুর যথার্থ বিকাশ শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও শিশুর বৃদ্ধি শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। কিন্তু তবুও , যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর বৃদ্ধিকে গঠনমূলক পথে পরিচালিত করা যায়। এছাড়াও শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি শিশুর দৈহিক , বৌদ্ধিক , সামাজিক , কৃষ্টিমূলক , নৈতিক , সৃজনশীল , প্রাক্ষোভিক , মূল্যবোধ - ইত্যাদির সর্বাঙ্গীন বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হয়। 

৬. অভিযোজনের লক্ষ্য :- 
Horney ও Raymont উভয়ই শিক্ষার অভিযোজনের লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে অভিযোজনের হাত ধরেই। যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে শিশু পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন ঘটিয়ে নিজের বিকাশ ঘটাতে পারে। 


৭. নৈতিক লক্ষ্য :- 
শিক্ষার নৈতিক লক্ষ্যের অন্যতম প্রবক্তা হলেন হার্বার্ট। তাঁর মতে , শিক্ষা একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হল শিশুর নৈতিকতার বিকাশ। দার্শনিক Locke শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনকেই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে দাবী করেছেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছেন - শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষের নৈতিক গুণাবলীকে বিকশিত করা। 

৮. আধ্যাত্মিক লক্ষ্য :- 
শিক্ষার আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন ভাববাদী শিক্ষা - দার্শনিকগণ। রবীন্দ্রনাথ , স্বামী বিবেকানন্দ , ফ্রয়েবেল - সকলেই শিক্ষার আধ্যাত্মিক লক্ষ্যকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁদের মতে , সকল শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল নিজেকে জানা এবং নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে এই জগতের সকল বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করা। 

৯. কৃষ্টিমূলক ও সৃজনশীলতার লক্ষ্য :- 
শিক্ষা মানুষের কল্পনাশক্তি , দার্শনিকবোধ - ইত্যাদির উন্নতি ঘটিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে সৃজনশীল মনোভাব গড়ে তোলে। শিক্ষা ব্যক্তির কৃষ্টি ও সৃজনশীলতাকে যথার্থ পথে পরিচালিত করে। বস্তুতঃ মানব সভ্যতার বিকাশলাভ ঘটেছে ব্যক্তির কৃষ্টিমূলক ও সৃজনশীল মানসিকতার মাধ্যমেই। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির সেই সৃজনশীলতাকে সঠিক অভিমুখে পরিচালিত করা বাঞ্চনীয়। 

১০. সাংস্কৃতিক লক্ষ্য :- 
প্রতিটি সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি বর্তমান। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের পরিচিত সমাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার পাশাপাশি বৃহত্তর জগতে প্রচলিত সংস্কৃতি সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করে। এইভাবে শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি যেমন একদিকে সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে তেমনি অন্যদিকে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঞ্চালনেও শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। 

১১. গণতান্ত্রিকতার লক্ষ্য :- 
বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শগুলির মধ্যে গণতান্ত্রিকতার আদর্শ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সমাজ গণতন্ত্রকে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থান দিয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি গণতন্ত্রের মূল বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাব গড়ে ওঠে। এইভাবে জাতীয় জীবনে শিক্ষা গণতন্ত্রের প্রসারে সহায়ক হয়ে ওঠে। 

১২. জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবোধের লক্ষ্য :- 
জাতীয় সংহতি রক্ষার একটি প্রধান উপাদান হল শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি তার জাতীয় জীবন সম্পর্কে পরিচিত হয়। নিজেদের ভাষা , সংস্কৃতি , ঐতিহ্য - ইত্যাদির ভিত্তিতে তারা একটি জাতিতে পরিণত হয় এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শিক্ষা একটি প্রধান উপাদান। শিক্ষা ব্যতীত কোনো সমাজেই সুষ্ঠভাবে জাতীয় সংহতি রক্ষা ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানো সম্ভব নয়। 

পরিশেষে বলা যায় যে , আধুনিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন। সেই লক্ষ্য চরিতার্থ করতে শিক্ষা ব্যক্তিজীবনের ভিন্ন ভিন্ন বিকাশের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে ; যার ফলে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই কল্যাণসাধন হয়।  

 

You May Also Like

0 comments