শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কাকে বলে ? শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।

by - October 07, 2023

শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কাকে বলে ? শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর। 

শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য : ধারণা , সুবিধা ও অসুবিধা। 




শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের ধারণা :- 


শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের প্রবক্তাদের মতে শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য শিক্ষাকে সমাজকল্যাণের উপাদান হিসাবে পরিচালিত করে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই বিকাশ সাধন করে। প্রতিটি শিশু সমাজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে এবং সমাজের মধ্যেই বেড়ে ওঠে এবং সমগ্র জীবন অতিবাহিত করে। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমাজের একটি বিরাট ভূমিকা থাকে। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির সমাজের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। 

হেগেল বলেছেন , রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতির মধ্যে দিয়েই ব্যক্তি কল্যাণ সম্ভব। ব্যক্তির স্বার্থেই শিক্ষা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

মনোবিদ রস শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে , সমাজের কল্যাণের মধ্যে দিয়েই ব্যক্তির কল্যাণ সাধিত হয়। 

ডিউই - এর মতে , সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন প্রকার সামর্থ্য গড়ে তোলে। এই সামর্থ্যগুলি ছাড়া ব্যক্তির জীবন পরিপূর্ণ হতে পারে না।  


শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা :-


(i) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর জীবন রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বে গড়ে ওঠে। ফলে যারা দুর্বল , বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন - তাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে শিক্ষা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদান করে। 

(ii) শিক্ষার পরিকাঠামো , গতিধারা - ইত্যাদি নির্ধারণ করে সমাজ। তাই সমাজ কল্যাণ ব্যাতীত অন্য কোনো লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হতে পারেনা। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উন্নতি সাধিত হলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির কল্যাণ সংগঠিত হয়। 

(iii) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষায় ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন নিয়ম , আদব - কায়দা , রীতিনীতি - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। 

(iv) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের সমাজের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে এবং সেই মত নিজেকে পরিচালিত করতে পারে। 

(v) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে যথার্থ অভিযোজনে সাহায্য করে। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে বিশেষ বিশেষ সামর্থ্য প্রদান করে তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে। ফলে ব্যক্তি তার সমাজে একজন সফল নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। 

(vi) সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা সমাজে শিক্ষার প্রসারকে সর্বজনীন করে তোলে। সমাজে যদি শুধুমাত্র শিক্ষার  ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য প্রচলিত থাকতো তাহলে শিক্ষা সমাজের কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থেই শিক্ষা পরিচালিত হত। কিন্তু শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য সেই সমস্যার সমাধান করে। 

(vii) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য সমাজে শ্রমবিভাজনের গতিধারাকে অব্যাহত রাখে। শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীলতার সঙ্গে পরিচিত করায়। ফলে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীলতার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। 


শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের অসুবিধা / সীমাবদ্ধতা :- 


(i) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে মনোবিজ্ঞান তীব্রভাবে সমালোচনা করে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে প্রতিটি শিশু স্বতন্ত্র্য সত্তা নিয়ে জন্মায়। তাদের প্রত্যেকের চাহিদা , সামর্থ্য , দক্ষতা - সবই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাধারা শিশুদের সেই ভিন্নতাকে গুরুত্ব না দিয়ে সকলকে একই ধরণের শিক্ষায় অভ্যস্থ করে তোলার পক্ষপাতী - যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। 

(ii) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য সামাজিক শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষিত হয় ; শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। 

(iii) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়না। এইভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা বাধা পেয়ে তা পক্ষান্তরে সমাজের অগ্রগতিকেই প্রতিরোধ করে। 

(iv) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে শিক্ষার লক্ষ্য শাসকের আদর্শে প্রভাবিত হতে বাধ্য। শাসক নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে শিক্ষাধারাকে পরিচালিত করতে পারেন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে। 

(v) যেহেতু শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে ব্যক্তির স্বতন্ত্র্য চাহিদাগুলিকে উপেক্ষা করা হয় তাই সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কখনোই ব্যক্তির সৃজনশীলতা ও কৃষ্টিমূলক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারেনা। 

(vi) শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা , সামর্থ্য ও আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়না। 

(vii) যেহেতু শিক্ষার্থী তাঁর নিজের অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশ স্বাভাবিকভাবে ঘটাতে পারেনা , তাই সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাধারা গণতন্ত্রেরও পরিপন্থী।  

পরিশেষে বলা যায় , শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও তার নেতিবাচক দিকগুলিকে উপেক্ষা করা যায়না। সমাজে শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাধারা প্রচলিত হওয়া কখনোই কাম্য নয়।  


You May Also Like

0 comments