স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - November 26, 2022

স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

স্বাধীনতার বিভিন্ন শর্তগুলি কী কী ? 



স্বাধীনতার রক্ষাকবচ :- 


প্রতিটি উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যেসকল বিশেষ ব্যবস্থা বলবৎ থাকে - সেগুলিকেই বলে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। অধ্যাপক ল্যাস্কি এইসকল বিধিব্যবস্থাগুলিকে স্বাধীনতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতিটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি গুরুত্বপূর্ণ , কেননা , এগুলি ছাড়া স্বাধীনতাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায়না। 
স্বাধীনতা কখনোই অবাধ হতে পারেনা ; কেননা , অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। তাই যথার্থ স্বাধীনতা বলতে আইনগত স্বাধীনতাকেই বলা হয়। আইন স্বাধীনতাকে সুনির্দিষ্ট করে ও পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি হল - 


১. সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা ও মৌলিক অধিকার :-
সংবিধানে লিখিত মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ বলে অনেকে মনে করেন। মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে জনগণ সেগুলির বিষয়ে সচেতন থাকে এবং মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। অপরদিকে রাষ্ট্র নাগরিকদের এইসকল মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর থাকে। ভারতীয় সংবিধানে লিখিত কয়েকটি মৌলিক অধিকার হল - বাক স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা , ধর্মীয় স্বাধীনতা - ইত্যাদি। মূলতঃ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার তথা স্বাধীনতার উপর সরকারি হস্তক্ষেপকে প্রতিরোধ করতেই মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়। 

২. ক্ষমতা - স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ :- 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স - ইত্যাদি রাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার - এই প্রতিটি বিভাগ পরস্পর নিরপেক্ষ থাকবে ; অর্থাৎ এক বিভাগ অপর বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কেননা এক বা একাধিক ব্যক্তিসমষ্টি যদি একাধিক বিভাগের ক্ষমতা অধিকার করেন - তাহলে সেই ক্ষমতা সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে খুব সহজেই স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে। এই সকল কারণে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বাধীনতা রক্ষা করার অন্যতম রক্ষাকবচ। 

৩. ক্ষমতা - বিকেন্দ্রীকরণ :- 
রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা যদি কেবলমাত্র একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পিত হয় - তাহলে সেখানে স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শাসন - ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশের মধ্যে বন্টিত হয়। এর ফলে কোনো একটি কর্তৃপক্ষ এককভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না ; ফলে নাগরিকদের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত হয়। ল্যাস্কি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। 

৪. আইনের অনুশাসন :- 
অধ্যাপক ডাইসি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আইনের অনুশাসনকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে বর্ণনা করেছেন। আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায় - (ক) আইন ও সংবিধানের প্রাধান্য , (খ) আইনের দৃষ্টিতে সাম্য , (গ) আইন কর্তৃক সকলের সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন বলবৎ থাকে ; এর ফলে রাষ্ট্র বা সরকার নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে নাগরিক অধিকার ভঙ্গ করতে পারেনা। নাগরিকদের স্বাধীনতা আইন কর্তৃক সংরক্ষিত হলে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। 


৫. জনগণের প্রতিনিধিত্ব :- 
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃত হলে স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। জনগণের প্রতিনিধিত্বে শাসন ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। জনগণ কর্তৃক সরকার নির্বাচিত হয় এবং জনগণের ইচ্ছা - অনিচ্ছা ও আশা - আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হন। ফলে নাগরিক স্বাধীনতা অধিক মাত্রায় সুরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

৬. সরকারের দায়িত্বশীলতা :- 
সরকারের দায়িত্বশীলতা স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। সরকার জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল থাকলে সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যেমন , ভারতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যৌথভাবে জনগণ ও আইনসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকে। এই  ধরণের রাষ্ট্র - ব্যবস্থায় নাগরিকদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। 

৭. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা :- 
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা স্বাধীনতার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। মানুষের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারগুলি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয় , ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় , মানুষ তার ব্যক্তিস্বাধীনতা চরিতার্থ করতে পারে। তাই স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার্থে প্রতিটি রাষ্ট্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা বলবৎ থাকা উচিত। 

৮. জনমত :- 
জনমত হল স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলির মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ উপাদান। স্বাধীনতার উপর যেকোনো ধরণের হস্তক্ষেপে জনমত প্রবলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ স্বাধীনতা রক্ষার একটি শক্তিশালী উপাদান। রাষ্ট্র জনমতের বিরোধিতার ভয়ে জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস তাই সদাসতর্ক জনমতকে স্বাধীনতা রক্ষার মূলসূত্র হিসাবে দাবী করেছেন। নাগরিকেরা স্বাধীনতার রক্ষার প্রয়োজনে আন্দোলন - বিপ্লব - বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। 

৯. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা :- 
রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক কাঠামো স্বাধীনতা রক্ষা করার একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। নির্বাচন , পদগ্রহন ও পদচ্যুতি , প্রশাসন পরিচালনা , স্বায়ত্তশাসন - ইত্যাদি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামো বলবৎ থাকলে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশগ্রহন করতে পারে এবং নিজেদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে পারে। 

১০. সর্বজনীন শিক্ষা :- 
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বজনীন শিক্ষাকে স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে মনে করা হয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ নিজেদের অদিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন এবং স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সমাজে শিক্ষার অভাব স্বাধীনতাকে খর্ব করে। 

পরিশেষে বলা যায় , স্বাধীনতা রক্ষার উল্লিখিত রক্ষাকবচগুলি এক - একটি আনুষ্ঠানিক ও বিধিবদ্ধ মাধ্যম। এর সঙ্গে জড়িত থাকে আরো বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর থাকলেও জনগণের স্বাধীনতার অধিকার ক্ষুন্ন হলে জনগণকে বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হতে হয় বা প্রতিবাদ ও বৈপ্লবিক আন্দোলনে সামিল হতে হয়।     

    

You May Also Like

0 comments