সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক।

by - November 26, 2022

সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক। 

সাম্য ও স্বাধীনতা কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত - সে বিষয়ে আলোচনা কর। 




সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক :- 


লর্ড অ্যাক্টন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপন্থী বলে মনে করলেও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বলা যায় যে সাম্য ও স্বাধীনতা আদৌ একে - অপরের পরিপন্থী নয় ; তারা পরস্পরের পরিপূরক। সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে স্বাধীনতা কখনোই তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনা। কেননা , মানুষ স্বাধীনতার অধিকারগুলিকে চরিতার্থ করতে পারে তখনই যখন তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সমাজে বিদ্যমান থাকে। তাই সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্কের বিষয়টিকে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন - 


১. প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্কের স্বরূপ :- 
প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাম্যের তুলনায় স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হত। প্রাচীন রোম , গ্রিস , মিশর - ইত্যাদি সভ্যতায় ক্রীতদাস প্রথা চালু থাকায় সাম্যের তুলনায় স্বাধীনতার বিষয়টি অধিক গুরুত্বলাভ করেছিল। এইভাবে মধ্যযুগ পর্যন্ত সাম্যের গুরুত্ব উপেক্ষিত থেকে যায়। এমনকি , জন লক যে তিনটি স্বাভাবিক অধিকারের কথা বলেছিলেন - তার মধ্যেও সাম্যের অধিকার উল্লিখিত ছিলনা। কোনো কোনো প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গ্রিক দার্শনিকগণ ক্রীতদাস প্রথার বিরোধিতা করে সাম্যের গুরুত্বের কথা তুলে ধরলেও তা রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। 

২. সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক :- 
১৭৭৬ সালে আমেরিকার অধিকারপত্র ঘোষণা এবং ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত নাগরিকদের অধিকার ঘোষণায় সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত তিনটি মহান আদর্শ ছিল - সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই চিন্তাধারার হাত ধরেই সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এছাড়াও সাঁ সিমো , রবার্ট ওয়েন , মোরলি - প্রমুখের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টির উল্লেখ ছিল। 

৩. সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপন্থী :- 
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপন্থী - এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন লর্ড অ্যাক্টন। পরবর্তীকালে স্পেনসার , লেকি - প্রমুখেরাও লর্ড অ্যাকটনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপন্থী বলে প্রচার করেন। সাম্য নীতির প্রতিষ্ঠা - ধনবান , অভিজাত , রাজপরিবার , ধর্মযাজক - এই ধরণের ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে - তাই তারাও সাম্যের বিরোধিতা করেন। লেকি তাঁর বিখ্যাত - Democracy and Liberty - গ্রন্থে গণতন্ত্রকে স্বাধীনতার বিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন সাম্য নীতির প্রতিষ্ঠা সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণীগুলির মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য ও নির্ভরশীলতার চরম ক্ষতি করে। 

৪. ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্কের ধারণার বিবর্তন :- 
ঊনবিংশ শতকে সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের ধারণার বিবর্তন ঘটে। যেসকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের হাত ধরে এই পরিবর্তন ঘটে তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। তিনি সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে দাবী করেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিংশ শতকে ল্যাস্কি , বার্কার - প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে প্রচার করেন। দার্শনিক রুশোও অনুরূপ অভিমতের পক্ষে সওয়াল করেন। ল্যাস্কি বলেছেন - সাম্য ব্যতীত যথার্থ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। 


৫. ল্যাস্কির অভিমত :- 
ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত ও উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে , অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত কখনোই প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভিত্তিহীন। 
ল্যাস্কি সমাজে সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সহাবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই কার্যকর হবে যখন সামাজিক সংগঠন , রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান , সরকার পরিচালনা , নীতি নির্ধারণ - ইত্যাদি বিষয়গুলিতে জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্য নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই ল্যাস্কি এমন এক সমাজের কথা বলেছেন যেখানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি ঘটবে। 

৬. মার্কসবাদীদের অভিমত :- 
সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে ল্যাস্কি ও মার্কসবাদীরা অভিন্ন মনোভাব পোষণ করেন। মার্কসবাদীদের মতে , সমাজে সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে শ্রেণি শোষণের যন্ত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির মানুষ অপর শ্রেণিকে শোষণ করবে। তাই মার্কসবাদীরা শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কথা বলেন। ল্যাস্কির মতোই মার্কসবাদীরাও সাম্যকে স্বাধীনতার প্রধান শর্ত বলে দাবী করেছেন।  

৭. বার্কারের অভিমত :- 
বার্কার শোষণমুক্ত সমাজের পক্ষে সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়কেই গুরুত্বপূর্ণ বলে করেন। বার্কার মানবজীবনে ও সমাজজীবনে স্বাধীনতাকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য স্বাধীনতা একান্ত অপরিহার্য এবং এই স্বাধীনতাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে গেলে সাম্য অপরিহার্য। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory গ্রন্থে সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয়সাধনের কথা বলেছেন। 

৮. R. H. Tawney র অভিমত :- 
সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়ই আইনগত ধারণামাত্র। সাম্য কখনোই স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারেনা। স্বাধীনতা রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের দ্বারা সংরক্ষিত হয়। রাষ্ট্র সমাজে প্রচলিত বিশেষ সুযোগ সুবিধার অবসান ঘটিয়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সাম্য ও স্বাধীনতার যথার্থ সহাবস্থান সম্ভব হতে পারে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য নীতি প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক , রাজনৈতিক - প্রভৃতি সকল প্রকার স্বাধীনতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় যে , সাম্য ও স্বাধীনতা কখনোই পরস্পরের বিরোধী নয় ;তারা পরস্পরের সহায়ক। প্রতিটি উদারনৈতিক - গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাম্য ও স্বাধীনতার সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সমাজে প্রয়োজন স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হল সাম্য।      


You May Also Like

0 comments